ড্রাগন চাষে আয়ের পথ দেখাচ্ছেন আবদুর রহিম

গাছে ড্রাগন ফল। নওগাঁর পোরশা উপজেলার কাটপুকুরিয়া এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

উঁচু বরেন্দ্র এলাকা নওগাঁর পোরশা। এই উপজেলার বেশির ভাগ মানুষ কৃষিজীবী। জমিতে ধান ও সবজির পাশাপাশি অনেকেই জড়িয়েছেন আম চাষে। তাঁদের মধ্যে ব্যতিক্রম আবদুর রহিম। চাষ করেছেন ড্রাগন ফলের। এখানেই শেষ নয়, আবদুর রহিম শাহর ড্রাগন পথ দেখাচ্ছে অন্যদের। তাঁর দেখাদেখি অনেকে শুরু করেছেন ড্রাগন ফলের চাষ।

আবদুর রহিমের (৫০) বাড়ি উপজেলার নিতপুর ইউনিয়নের পোরশা গ্রামে। পেশায় তিনি মাদ্রাসাশিক্ষক। পোরশা বড় মাদ্রাসায় তিনি শিক্ষকতা করেন। পাশাপাশি তিনি কৃষিকাজ করেন। উপজেলার তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের কাটপুকুরিয়া এলাকায় নিজের ২৪ বিঘা জমিতে ড্রাগন চাষ করেছেন তিনি।

বুধবার আবদুর রহিমের বাগানে ঘুরে দেখা যায়, চারদিকে সবুজের সমারোহ। প্রায় পাঁচ ফুট উচ্চতার প্রতিটি কংক্রিটের খুঁটি পেঁচিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে ড্রাগন ফলের গাছ। প্রতিটি গাছে ঝুলছে তিনটি থেকে চারটি করে কাঁচা, পাকা ও আধা পাকা ড্রাগন ফল। বাগানে কাজ করছিলেন ২০-২৫ জন শ্রমিক। তাঁদের মধ্যে ছয়-সাতজন গাছ থেকে পাকা ফল সংগ্রহ করছিলেন। অন্যরা নিড়ানি দিয়ে আগাছা তুলছিলেন।
বাগানে কথা হয় আবদুর রহিমের ম্যানেজার ও চাচাতো ভাই তারেকুল ইসলাম শাহর সঙ্গে। তিনি বলেন, কাটপুকুরিয়ায় আট বিঘা জায়গাজুড়ে রহিম শাহ ২০১৮ সালের আগস্টের দিকে ড্রাগন ফলের চাষ শুরু করেন। এর পাঁচ-ছয় মাস পর সেখানে তিনি আরও ১৬ বিঘা জমিতে ড্রাগন ফলের চারা লাগান। মোট ২৪ বিঘা জমির এই বাগানে ৪০ হাজারের বেশি ড্রাগনগাছ আছে। চারা লাগানোর ১৫-১৬ মাস পর গত বছরই প্রথম গাছে ফল আসে। প্রথম বছর আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিটি গাছে তিনটি থেকে চারটি করে ফল ধরেছিল।

গত বছর প্রায় আট লাখ টাকার ফল বিক্রি হয়েছে। এবার গাছগুলোতে গত বছরের তুলনায় ফল ধরছে ভালো। মে থেকে ফল সংগ্রহ শুরু হয়েছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত সংগ্রহ করা যাবে। এ বছর মৌসুমের শুরুতে আমসহ বাজারে অন্যান্য গ্রীষ্মকালীন ফল থাকায় ড্রাগনের দাম কিছুটা কম ছিল। মে ও জুন মাসের দিকে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা কেজি পাইকারি দরে ড্রাগন বিক্রি হয়েছে। তবে বাজারে অন্যান্য ফল কম থাকায় এখন ড্রাগনের চাহিদা বেড়ে গেছে। এখন বাগান থেকে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা কেজি পাইকারি দরে ব্যবসায়ীদের কাছে ড্রাগন বিক্রি হচ্ছে। ফল সংগ্রহ শুরুর প্রথম চার মাসে ইতিমধ্যে প্রায় ১৫ লাখ টাকার ফল বিক্রি হয়েছে। আগামী তিন মাসে আরও ১০-১২ লাখ টাকার ফল বিক্রির আশাবাদ তাঁর।

বাগান থেকে ফল তুলছেন এক শ্রমিক
ছবি: প্রথম আলো

তারেকুল ইসলাম জানান, একটি ড্রাগন গাছ পরিপক্ব হতে তিন থেকে চার বছর লাগে। আর পরিপক্ব একটি গাছে প্রতি মৌসুমে ৩০ থেকে ৪০টি ড্রাগন ধরে। গাছ পরিপক্ব হয়ে গেলে এই বাগান থেকে প্রতি মৌসুমে কোটি টাকার বেশি ফল বিক্রি হবে। পরিশ্রম বেশি, তবে আমসহ অন্য যেকোনো ফলের চেয়ে ড্রাগন চাষ বেশি লাভজনক। ২৪ বিঘা জমিতে আম চাষ কিংবা ধান চাষ করে এর অর্ধেকও আয় করা সম্ভব নয়। রহিম শাহ এই বাগান দেখে পোরশা ছাড়াও নওগাঁর সাপাহার ও পত্নীতলা উপজেলার অনেক এলাকায় আরও ২০-২৫টি বাগান গড়ে উঠেছে।

বাগানমালিক আবদুর রহিম বলেন, ‘কাটপুকুরিয়া এলাকার ওই জায়গাটিতে আগে আমবাগান ছিল। ২০১৭ ও ২০১৮ সালে আমের দাম কম ছিল। ২০১৮ সালের দিকে আমগাছগুলো কেটে ওই ২৪ বিঘা জমিতে বরইবাগান করার চিন্তাভাবনা করছিলাম। ওই সময় নওগাঁ শহরের একটি মাদ্রাসায় চাকরি করা আমার এক বন্ধুর সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ হয়। তখন ওই বন্ধু আমাকে ড্রাগন ফল চাষের পরামর্শ দেন। যশোরের এক ড্রাগনচাষির সঙ্গে আমাকে ফোনে কথাও বলিয়ে দেন। তাঁদের দুজনের পরামর্শে সাহস করে ২০১৮ সালে আগস্ট এবং ২০১৯ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে প্রতিটি ড্রাগন চারা ৩০ থেকে ৩৫ টাকা দামে যশোর থেকে কিনে আনি। ২৪ বিঘা জমিতে মোট ৪৫ হাজার ড্রাগন চারা লাগাই। এর মধ্যে খুব কম চারাই নষ্ট হয়েছে। জমি প্রস্তুত, চারা ক্রয় ও লাগানো, কংক্রিটের খুঁটি লাগানো, পরিচর্যাসহ প্রথম বছরেই প্রায় ৩৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। গাছ পরিপক্ব হয়ে গেলে প্রতিবছর কীটনাশক ও সার ব্যবহার এবং পরিচর্যা বাবদ ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা খরচ করে এই বাগান থেকে প্রায় দেড় কোটি টাকা আয় করা সম্ভব বলে আমার মনে হচ্ছে।’

আবদুর রহিমের দেখাদেখি কাটপুকুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা ও স্কুলশিক্ষক শহিদুল ইসলামও ড্রাগন চাষে নেমেছেন। তিনি বলেন, ‘রহিম শাহর উদ্যোগটি বেশ লাভজনক। বরেন্দ্র এলাকার এই উঁচু জমিতে এই ফল চাষ শুরু করলে প্রথম দিকে আমরা এটিকে পাগলামি বলেছিলাম। কিন্তু এখন তাঁর বাগান ও ফল দেখে ধারণা পাল্টে গেছে। আমিও বাড়ির পাশের ৪০ শতাংশ জমিতে জানুয়ারি মাসে ২ হাজার ড্রাগন গাছ লাগিয়েছি।’
পোরশা উপজেলার নিতপুর সদর ইউনিয়ন ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আবদুল হাই বলেন, ‘বরেন্দ্র ভূমি উঁচু হওয়ায় নওগাঁর পোরশা, সাপাহার ও পত্নীতলার কিছু এলাকা ড্রাগন ফলের জন্য খুবই উপযোগী। এখানকার ফলের আকারও বেশ বড় ও সুমিষ্ট। রহিম শাহর ড্রাগন ফলের চাষ শুরুর পর থেকেই কখন কী ধরনের গাছের পরিচর্যা নিতে হবে, সে বিষয়ে আমরা তাঁকে পরামর্শ দিয়ে আসছি। তাঁর সফলতা দেখে অনেক কৃষক এখন আমাদের কাছে ড্রাগন চাষের জন্য পরামর্শ নিতে আসছেন।’

কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সব ধরনের মাটিতে ড্রাগন চাষ হয়। তবে উঁচু জমিতে ভালো ফলন পাওয়া যায়। তিন মিটার পরপর গর্ত করে চারা রোপণ করতে হয়। বছরের যেকোনো সময় চারা রোপণ করা যায়। তবে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। সিমেন্ট অথবা বাঁশের খুঁটিতে গাছ বেঁধে দিতে হয়। গাছে ফুল আসার ২০-২৫ দিনের মধ্যে ফল ধরে। পুষ্টিগুণসম্পন্ন প্রতিটি ড্রাগন ফলের ওজন ২০০ থেকে ৫০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়। ২ থেকে ৪ বছর বয়সী একটি গাছে ৫ থেকে ১২টি ফল ধরে। পরিপক্ব একটি গাছে সর্বোচ্চ ৪০টি ফল পাওয়া যায়। ছাদবাগানের টবেও ড্রাগন ফল চাষ করা যায়।