ঢাকা থেকে ভাঙ্গা এক ঘণ্টায়

ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে। ৮ ডিসেম্বর ফরিদপুরেরর ভাঙ্গায়ছবি: সত্যজিৎ ঘোষ

ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গার দূরত্ব ৬০ কিলোমিটারের মতো। এ পথটুকু গণপরিবহনে যেতে এখন আড়াই থেকে চার ঘণ্টা লাগে—পদ্মা পারাপারে স্পিডবোট, লঞ্চ বা ফেরি যে মাধ্যমই ব্যবহার করা হোক।

পদ্মা সেতু চালু হলে এ পথ যেতে এক ঘণ্টার বেশি লাগবে না। দুই পাশে এক্সপ্রেসওয়ে চালু হয়ে গেছে গত মার্চে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ এখন পদ্মা সেতু চালু হওয়ার অপেক্ষায়।

আজ বৃহস্পতিবার সর্বশেষ স্প্যান স্থাপনের মধ্য দিয়ে পদ্মার দুই পার মাওয়া ও জাজিরা সংযুক্ত হচ্ছে। সরকার আগামী বছরের ডিসেম্বর নাগাদ পদ্মা সেতু চালুর কথা চিন্তা করছে।

এর আগে পদ্মা সেতুতে যানবাহন চলাচল নির্বিঘ্ন করতে ঢাকা থেকে মাওয়া এবং জাজিরা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়েছে ৫৫ কিলোমিটারের এক্সপ্রেসওয়ে। ব্যয় হয়েছে প্রায় ১১ হাজার ৪ কোটি টাকা। এটি সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্পেশাল ওয়ার্কস অর্গানাইজেশন (পশ্চিম)। ২০১৬ সালে এক্সপ্রেসওয়েটির কাজ শুরু হয়। গত মার্চে এটি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূল এক্সপ্রেসওয়ে চার লেনের। আর সেতুর দুই পাশে ধীরগতির যানবাহন চলাচলের জন্য সাড়ে পাঁচ মিটার প্রশস্ত সড়কও রাখা হয়েছে। দেশের প্রথম এই এক্সপ্রেসওয়েতে ৫টি ফ্লাইওভার, ১৯টি আন্ডারপাস এবং প্রায় ১০০টি সেতু ও কালভার্ট রয়েছে।

পদ্মা সেতুতে যানবাহন চলাচল নির্বিঘ্ন করতে ঢাকা থেকে মাওয়া এবং জাজিরা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়েছে ৫৫ কিলোমিটারের এক্সপ্রেসওয়ে। ব্যয় হয়েছে প্রায় ১১ হাজার ৪ কোটি টাকা।

মোটরসাইকেল নিয়ে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে মাওয়া পর্যন্ত গিয়ে দেখা গেছে, সময় লাগে ৩৫ থেকে ৪০ মিনিট। আর পদ্মার ওপারে জাজিরা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত যেতে সময় লাগে ২০ মিনিটের মতো। তবে মাওয়ায় যেতে এখনো এক্সপ্রেসওয়েতে কিছু কিছু বিশৃঙ্খলা দেখা যায়।

৪০ মিনিটে মাওয়া

ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের বর্তমান অবস্থা দেখতে গত মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার দিয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে রওনা হলাম। ফ্লাইওভারের এ অংশ মিশেছে দোলাইরপাড়ে। সেখান থেকেই শুরু ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে।

জুরাইনের দিকে যেতেই চোখে পড়বে নৌকার আদলে তৈরি হচ্ছে একটি পদচারী–সেতু। জুরাইন অংশের নিচে অবশ্য এখন হযবরল অবস্থা। রাস্তার মধ্যে বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানো, রাস্তার একাংশে পার্কিং, অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল ও পথচারী চলাচলে যানবাহনের গতি ধীর হয়ে যায়।

পোস্তগোলা ব্রিজ পেরিয়ে কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ অংশে দেখা গেল, হাতের ইশারায় গাড়ি থামিয়ে দৌড়ে সড়ক পার হন পথচারীরা। সড়কদ্বীপ পার হন লাফিয়ে। নির্ঝঞ্ঝাট মহাসড়কের সুখ পাওয়া যায় কেরানীগঞ্জের ইকুরিয়া অংশ থেকে। তবে এ পথে সর্বোচ্চ গতিসীমা ৬০ কিলোমিটার। যদিও সেটা মানা হয় না।

নির্দিষ্ট স্থানে বাস থামার কথা থাকলেও আবদুল্লাহপুরের স্টপেজে তা মানা হয় না। সেখানে সড়কের মধ্যেই বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানো হয়, যদিও বাস থামানোর জায়গা রয়েছে। এক্সপ্রেসওয়ের ভাঙা বেষ্টনী গলে মহাসড়কে হিউম্যান হলারও উঠতে দেখা গেল। নিয়ম না মানা ও বেপরোয়া চালানোর কারণে এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনাও ঘটে। শ্রীনগর এলাকায় দেখা গেল, দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত একটি কাঠামো মেরামত করছেন শ্রমিকেরা।

এ পথে চলাচলকারী বাসের চালকেরা জানালেন, কোথাও থামিয়ে যাত্রী না নিলে মোটামুটি ৪০ মিনিটে মাওয়া যাওয়া যায়।

মাওয়া যাওয়ার পরে পদ্মা পাড়ি দিতে ফেরিঘাটে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। ফেরিঘাটের কর্মীরা জানান, সাধারণ সময়ে গাড়ি ফেরিতে ওঠার পর নদী পার হতে সময় লাগে সোয়া ঘণ্টা থেকে দেড় ঘণ্টা। তবে যানবাহনের চাপ, কুয়াশা-ঝড়, বন্যা, নদীতে নাব্যতাসংকট ইত্যাদি সমস্যা লেগেই থাকে। যানবাহন ফেরিতে উঠতেই দীর্ঘ সময় লাগে। এ কারণে এখন অনেকেই সরাসরি বাসে দক্ষিণের জেলাগুলোতে যান না। তার বদলে ঢাকা থেকে মাওয়া পর্যন্ত গিয়ে নেমে যান।

ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে যাঁরা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে যান, তাঁদের পদ্মা পাড়ি দিতে হয় ফেরি, লঞ্চ অথবা স্পিডবোটে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) সূত্র জানায়, বর্তমানে মাওয়া দিয়ে নৌপথে প্রতিদিন প্রায় চার হাজার যাত্রী ও পণ্যবাহী যানবাহন পারাপার হয়। আর যাত্রী পারাপার হয় দৈনিক গড়ে দুই লাখ। পারাপারের জন্য ১৬টি ফেরি রয়েছে। শুধু যাত্রী পারাপারের জন্য ৮৭টি লঞ্চ ও ২৫০টি স্পিডবোট চলাচল করে।

জাজিরা থেকে ভাঙ্গা ২০ মিনিটে

পদ্মার ওপারে জাজিরা প্রান্ত থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গার দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার। এ পথ যেতে সময় লাগে ২০ মিনিটের মতো। জাজিরা থেকে শিবচরের পাচ্চর পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক। এরপর এক্সপ্রেসওয়েতে বাকি ২০ কিলোমিটার। পুরো পথে কোথাও থামতে হয় না।

ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে গত মঙ্গলবার দুপুরে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন খুলনার সোনাডাঙ্গার দিদারুল ইসলাম। তিনি ঢাকায় চাকরি করেন। জরুরি প্রয়োজনে গ্রামে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ঢাকা থেকে বাসে মাওয়া যেতে এক ঘণ্টার মতো লাগে। জাজিরা থেকে ভাঙ্গা যেতে লাগে আধা ঘণ্টার মতো। কিন্তু পদ্মা সেতু চালু হয়ে গেলে সরাসরি বাসে এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগবে না। কারণ, পথে কোথাও থামতে হবে না। এই যাত্রী বলেন, এখন ফেরি পারাপার বাসে উঠলে তাঁর বাড়ি যেতে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা সময় লাগে।

কেরানীগঞ্জের ইকুরিয়া অংশ থেকেই পাওয়া যাবে মহাসড়কের সুখ। ৮ ডিসেম্বর।
ছবি: দীপু মালাকার

জাজিরা থেকে ভাঙ্গার পথে যানজটে পড়তে হয় না। ভাঙ্গায় চৌরাস্তার মোড়ে নির্মাণ করা হয়েছে ইন্টারসেকশন, যা দিয়ে যানবাহন না থেমেই বিভিন্ন জেলামুখী রাস্তায় যেতে পারে। ফলে সহজ হয়েছে ২১ জেলার মানুষের চলাচল।

ফরিদপুর জেলা বাস মালিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ফরিদপুরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলা পদ্মা নদীর কারণে ঢাকা থেকে বিচ্ছিন্ন। এক্সপ্রেসওয়ে চালু হয়ে গেছে। এবার পদ্মা সেতু চালু হলে সরাসরি বাস চলাচল বাড়বে। মানুষ সুফল পাবে।