তাঁর কোনো ছুটি নেই

শিক্ষক নুরুল ইসলাম। যাঁর ছুটির দিনটিও কাটে শিক্ষার্থীদের পড়িয়ে
শিক্ষক নুরুল ইসলাম। যাঁর ছুটির দিনটিও কাটে শিক্ষার্থীদের পড়িয়ে

বছর বত্রিশের নুরুল ইসলাম। কক্সবাজার সদর উপজেলার ঈদগাহ আদর্শ শিক্ষা নিকেতনের সহকারী শিক্ষক। এখানেই শেষ হতে পারত তাঁর কথা। কিন্তু তিনি আর সবার চেয়ে আলাদা। ১০ বছরের শিক্ষকতা জীবনে ছুটি নিয়েছেন মাত্র তিন দিন। সব সময় পাশে থাকেন শিক্ষার্থীদের। এমনকি তাঁর ছুটির দিনটি কাটে ক্লাসে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের পাঠদানে। মিলেছে কাজের স্বীকৃতিও। বিভিন্ন সময় সেরা শিক্ষকের ক্রেস্ট উঠেছে তাঁর হাতে। এলাকার মানুষ চেনেন ‘আদর্শ শিক্ষক’ হিসেবে।
ঈদগাহ আদর্শ শিক্ষা নিকেতনের প্রধান শিক্ষক এ কে এম আলমগীর জানান, সরকারি বিধি অনুযায়ী প্রত্যেক শিক্ষক বছরে ২০ দিন নৈমিত্তিক ছুটি ভোগ করতে পারেন। তা ছাড়া নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসা, অর্জিত ছুটিসহ বিভিন্ন প্রকার ছুটি ভোগ করার বিধানও আছে। কিন্তু নুরুল ইসলাম এমন একজন শিক্ষক, যিনি ১০ বছরে তাঁর প্রাপ্য ২০০ দিনের নৈমিত্তিক ছুটি থেকে মাত্র তিন দিন কাটিয়েছেন। তাও খুব বেশি জরুরি প্রয়োজনে। পেশার প্রতি তাঁর আন্তরিকতায় মুগ্ধ সবাই। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১০ বছর ধরে তাঁকে ‘বর্ষসেরা উপস্থিত শিক্ষক’ হিসেবে সম্মানিত করে আসছে।
বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা জানান, নুরুল ইসলাম প্রতিদিন তিন কিলোমিটার পথ হেঁটে বিদ্যালয়ে আসেন। ঘণ্টা পড়ার আগেই ক্লাসে ঢোকেন। সবার শেষে তিনি বাড়ি ফেরেন। বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র রমজান আলী বলে, কোনো বিষয় একবার না বুঝলে স্যার বারবার বুঝিয়ে দেন, যেন বাড়ি গিয়ে কোনো সমস্যা না হয়।
নবম শ্রেণির ছাত্রী ইসমত আরা বলে, জটিল বিষয়ও স্যার সহজ করে বোঝাতে পারেন। তিনি ছুটি নেন না বলে সিলেবাসও নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হয়।
ছুটি কেন নেন না জানতে চাইলে একগাল হাসি দিয়ে নুরুল ইসলাম বলেন, ‘ক্লাসে শিক্ষক না থাকলে শিক্ষার্থীদের অনেক ক্ষতি হয়। তা ছাড়া একজন শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলে অন্যদের ওপর চাপ পড়ে। শিক্ষার্থীরা পাঠদান থেকে বঞ্চিত হয়। তাই ছুটি নেওয়ার বিষয়টি বেমালুম ভুলে যাই। আল্লাহ যদি শরীর সুস্থ রাখেন, তাহলে এভাবেই সারা জীবন শিক্ষকতা করব। আমি বিশ্বাস করি, নিজ অবস্থান থেকে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও ভালোবাসা পেলে শিক্ষার্থীরা অনেক দূর এগিয়ে যাবে।’
নুরুল ইসলামের কর্মকাণ্ডে মুগ্ধ জেলা প্রশাসক মো. রুহুল আমিন। তিনি বলেন, নুরুল ইসলাম কক্সবাজারের অহংকার। তাঁর মতো আদর্শ শিক্ষক প্রতিটি বিদ্যালয়ে তৈরি করা গেলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটবে।
জানা যায়, ব্যক্তিজীবনে তিন সন্তানের জনক এই শিক্ষকের জন্ম ১৯৮২ সালে, সদর উপজেলার ইসলামাবাদ ইউনিয়নের ইউছুপেরখীল গ্রামে। বাবা কবির আহমদ কৃষিকাজের আয় দিয়ে তাঁকে লেখাপড়া করান। নুরুল ইসলাম ১৯৯৭ সালে ঈদগাহ আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ১৯৯৯ সালে কক্সবাজার সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ২০০১ সালে একই কলেজ থেকে বিএসসি পাস করেন। এরপর কক্সবাজার যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে কম্পিউটারে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি ২০০৪ সালের ২৪ এপ্রিল ঈদগাহ আদর্শ শিক্ষা নিকেতনে সহকারী শিক্ষক (কম্পিউটার) পদে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বিএড পাস করেন। নুরুল ইসলাম বিদ্যালয়ে নবম ও দশম শ্রেণিতে রসায়ন, ইংরেজি ও কম্পিউটার শিক্ষা এবং অষ্টম শ্রেণিতে গণিত বিষয়ে পাঠদান করেন। গত ২৪ এপ্রিল এ বিদ্যালয়ে তাঁর চাকরির ১০ বছর পূর্ণ হয়।