ত্বকী হত্যাকাণ্ড নিয়ে সংবাদের জেরে পত্রিকা কার্যালয়ে হামলা, হুমকির অভিযোগ

অর্ধশতাধিক মোটরসাইকেল নিয়ে মহড়া দিয়ে নারায়ণগঞ্জের দৈনিক সময়ের নারায়ণগঞ্জ পত্রিকা কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ত্বকী হত্যাকাণ্ড নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জেরে আজমেরী ওসমানের অনুসারীরা এই হামলা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ।

সময়ের নারায়ণগঞ্জ পত্রিকা কার্যালয়ে ঢুকে হুমকি দিচ্ছেন হামলাকারীরা
ছবি: সংগৃহীত

শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টায় শহরের চাষাঢ়া প্রেসিডেন্ট রোড এলাকায় সিরাজ ম্যানশনের চারতলায় অবস্থিত পত্রিকা কার্যালয়ে এই ঘটনা ঘটে। পত্রিকাটির সাংবাদিকেরা অভিযোগ করেছেন, হামলাকারীরা সাংবাদিকদের গালাগাল করে এবং মাফ না চাইলে সম্পাদককে গুলি করে হত্যার হুমকি দিয়েছেন। হামলার পর সেখানকার সিসি ক্যামেরা ভাঙচুর ও হার্ডডিস্ক ডিভাইস খুলে নিয়ে গেছেন সন্ত্রাসীরা। এ সময় শহরে সন্ত্রাসীদের মহড়ায় আতঙ্কের সৃষ্টি হয়।

এদিকে পত্রিকা অফিসে হামলার ঘটনার পর পুলিশ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে আজমেরী ওসমানের অনুসারী হিসেবে পরিচিত ইব্রাহিম, লিটন দাস, শ্যামল দাস, কৃষ্ণা (২৬), আছিব, ফয়সাল, হিরাসহ ১০ জনকে আটক করা হয়েছে। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহজামান। তিনি বলেন, কিছু দুষ্কৃতকারী এসে হামলা চালিয়েছেন। এই ঘটনায় মামলা হবে। জড়িত অন্য ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

সময়ের নারায়ণগঞ্জ পত্রিকার নিজস্ব প্রতিবেদক আরিফ হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, শনিবার দুপুর ১২টা ২৫ মিনিটে অফিসের নিচে অর্ধশতাধিক সন্ত্রাসী মোটরসাইকেলে এসে অবস্থান নেন। তাঁরা অফিসে ঢুকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করেন। শুক্রবার সময়ের নারায়ণগঞ্জ পত্রিকার প্রধান সংবাদ ছিল, ‘যা ছিল খসড়া চার্জশিটে’। সংবাদটি কেন প্রকাশ করা হয়েছে, তার কৈফিয়ত জানতে চান হামলাকারীরা। তাঁরা বলেন, ‘তোরা আজমেরী ওসমানের বিরুদ্ধে নিউজ করস। কালকের মধ্যে পত্রিকায় ক্ষমা না চাইলে পত্রিকা অফিস জ্বালিয়ে দেব ও সম্পাদককে গুলি করে মেরে ফেলব।’ হামলাকারীরা প্রায় ১৫ মিনিট কার্যালয়ে অবস্থান করে হুমকি দিয়ে চলে যান। এ সময় বিদ্যুতের লাইন বন্ধ করে দেন, সিসি ক্যামেরা ভাঙচুর করেন, একটি পিসির হার্ডডিস্কও খুলে নিয়ে গেছেন।

নারায়ণগঞ্জে পত্রিকা কার্যালয়ে হামলাকারীদের মোটরসাইকেল নিয়ে মহড়া
ছবি: সংগৃহীত

পত্রিকাটির আরেক নিজস্ব প্রতিবেদক মৃত্যুঞ্জয় রায় বলেন, হামলাকারীরা হুমকি দিয়ে বলেন, ‘তোরা সব নেশাখোর। ভাইকে (আজমেরী ওসমান) ইয়াবা আসক্ত লিখছোস কেন? তোরা ভাইয়ের (আজমেরী ওসমান) কাছে গিয়ে পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবি, মাফ না চাইলে পত্রিকা অফিস আগুনে জ্বালিয়ে দেব।’

হামলার একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বে আক্তার নূর, সুমন, সানি, ইসমাইল, আন্নান, কাজল, রুবেল, সিনাফি, রবিন, মনির, লক্ষ্মণ, কৃষ্ণা, রাতুলসহ শতাধিক ব্যক্তি এই হামলায় অংশ নেন। নাসির উদ্দিন আজমেরী ওসমানের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। নাসির উদ্দিন ও আক্তার নূর এর আগে একাধিকবার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।

আজমেরী ওসমান প্রয়াত সাংসদ নাসিম ওসমানের ছেলে ও নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা-সিদ্ধিরগঞ্জ) আসনের সাংসদ শামীম ওসমানের ভাতিজা।

ত্বকী হত্যা নিয়ে র‌্যাব সংবাদ সম্মেলনে (২০০৪ সালের ৫ মার্চ) সরবরাহ করা খসড়া অভিযোগপত্র আমরা হুবহু পত্রিকায় তুলে ধরেছি। সেখানে আমাদের নিজস্ব কোনো বক্তব্য ছিল না।
জাবেদ আহমেদ, প্রকাশক ও সম্পাদক, সময়ের নারায়ণগঞ্জ

পত্রিকা কার্যালয়ে হামলার আগে অর্ধশতাধিক মোটরসাইকেল নিয়ে হর্ন বাজিয়ে শহরে মহড়া দেন সন্ত্রাসীরা। ওই কার্যালয়ের নিরাপত্তা প্রহরী হাফিজউদ্দিন বলেন, হঠাৎ শতাধিক লোক এসে তাঁকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে ওপরে উঠে যান।

সময়ের নারায়ণগঞ্জ পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক জাবেদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ত্বকী হত্যা নিয়ে র‌্যাব সংবাদ সম্মেলনে (২০০৪ সালের ৫ মার্চ) সরবরাহ করা খসড়া অভিযোগপত্র আমরা হুবহু পত্রিকায় তুলে ধরেছি। সেখানে আমাদের নিজস্ব কোনো বক্তব্য ছিল না। ওই অভিযোগপত্রে আজমেরী ওসমানকে ইয়াবা আসক্ত উল্লেখ করা হয়েছিল। এ কারণে আজমেরী ওসমানের অনুসারী ক্যাডাররা ক্ষিপ্ত হয়ে পত্রিকা অফিসে হামলা চালায়।’

সম্পাদক জাবেদ আহমেদ বলেন, কার্যালয়ের সিসি ক্যামেরা ভাঙচুর করে ডিভিআর (ডিজিটাল ভিডিও রেকর্ডার) মেশিন ও একটি পিসির হার্ডডিস্ক নিয়ে গেছেন হামলাকারীরা। এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তবে এ বিষয়ে নাসির উদ্দিন ও আক্তার নূরের ব্যবহৃত মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।

সময়ের নারায়ণগঞ্জ পত্রিকা কার্যালয়ের ভাঙচুর হওয়া একটি কম্পিউটার
ছবি: সংগৃহীত

এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের সদস্যসচিব হালিম আজাদ বলেন, ত্বকী হত্যার বিচার চাওয়ায় আজমেরী ওসমান এখন বেপরোয়া। তিনি এখন বিচার চাওয়া সবার বিরুদ্ধে শহরে মিছিল করছেন। এটি প্রশাসনের ব্যর্থতার একটি বড় প্রমাণ। আজমেরী ওসমানসহ র‌্যাবের তদন্তে প্রকাশিত অভিযুক্ত সবাইকে আইনের আওতায় এনে বিচার শুরুর দাবি জানান হালিম আজাদ।

আরও পড়ুন

জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) জায়েদুল আলম বলেন, ‘বিষয়টি শুনেছি। তাঁরা যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা নেওয়া হবে। জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’ তিনি বলেন, এই ঘটনায় ১০ জনকে আটক করা হয়েছে। অন্য ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

২০১৩ সালের ৬ মার্চ নগরীর শায়েস্তা খাঁ রোডের বাসা থেকে বের হওয়ার পর নিখোঁজ হয় মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী। দুই দিন পর ৮ মার্চ শীতলক্ষ্যা নদীর কুমুদিনী শাখা খাল থেকে ত্বকীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই বছরের ১২ নভেম্বর আজমেরী ওসমানের সহযোগী সুলতান শওকত আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বে ত্বকীকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়।

আরও পড়ুন