দখল–দূষণে প্রাণ যায় যায়

মাংসের দোকান থেকে মুরগি ও গরুর রক্ত, উচ্ছিষ্ট নাড়িভুঁড়ি, হাড়—সব ফেলা হয় চিত্রা নদীতে।

চিত্রা নদী দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। নদীর ভেতর অবাধে ফেলা হচ্ছে ময়লা-আবর্জনা। গত শনিবার যশোরের বাঘারপাড়া বাজার এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

যশোরের চিত্রা নদী যৌবন হারিয়েছে আগেই। এর মধ্যে গত কয়েক বছরে দখল যে হারে বেড়েছে, তাতে চরম হুমকিতে নদীটির নাব্যতা। সেই সঙ্গে দিন দিন বাড়ছে দূষণের তীব্রতা। এতে নষ্ট হচ্ছে নদীর পানি ও জীববৈচিত্র্য। সব মিলিয়ে এখন চিত্রার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। এমন বাস্তবতায় বিশ্বজুড়ে আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস।

যশোর জেলার সদর ও বাঘারপাড়া উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে চিত্রা নদী। চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার দর্শনা শহরের দুই কিলোমিটার উজানে গোপালখালী এলাকায় মাথাভাঙ্গা থেকে বেরিয়েছে চিত্রা। এরপর ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলা হয়ে যশোর সদর উপজেলার আন্দুলপোতা দিয়ে যশোরে প্রবেশ করেছে। প্রায় চার কিলোমিটার দূরে লেবুতলায় নদীটি দুই ভাগ হয়েছে।

উত্তর-পূর্ব বা বাঁ দিকে একটি এবং ডান বা পূর্ব দিকে আরেকটি শাখা প্রবাহিত হয়েছে। বাঁ দিকের শাখাটি বাঘারপাড়া উপজেলার খাজুরা, বন্দবিলা, গাইদঘাট, সীমাখালী ও নারকেলবাড়িয়ার মধ্য দিয়ে মাগুরা শাখিলা উপজেলার পুলুমে কাজলা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। ডান দিকের শাখাটি বাঘারপাড়া উপজেলার বিল জলেশ্বরের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হয়েছে।

২০২০ সালের ৩০ জুলাই নিজ ওয়েবসাইটে এসব দখলদারের তালিকা প্রকাশ করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। তালিকায় বাঘারপাড়া উপজেলায় চিত্রা নদীর বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, নদীটি দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে দলীয় কার্যালয়, মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ, পুকুর, বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়ি। আংশিক তালিকায় এই নদীর ওপর ৪১টি অবৈধ দখলদার রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু পরে নদীর অবৈধ দখলদারদের যে পূর্ণাঙ্গ তালিকা পাঠানো হয়, তাতে ১২৬ জন দখলদারের নাম উল্লেখ করা হয়।

বাঘারপাড়া বাজারের পাশে চিত্রার ওপর ২০১১ সালে ১৮ দশমিক ৩০ মিটার দীর্ঘ একটি সেতু নির্মাণ করা হয়। এই সেতুই বেশি ভোগাচ্ছে চিত্রাকে। নদীর দুই পাড় মাটি দিয়ে ভরাট করে সেতুটি নির্মাণের ফলে নদের স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সেতুর পূর্ব দিকে চিত্রা নদীর ১১৮ হেক্টর এলাকাজুড়ে রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় দেশি প্রজাতির বিভিন্ন মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বড় অভয়াশ্রম। নদী দখল ও দূষণে অভয়াশ্রমটিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

নদীর পাশের বাসিন্দা ৭৪ বছর বয়সী আনোয়ার মেহেদী বলেন, ৬০-৬৫ বছর আগেও চিত্রা প্রমত্তা ছিল। জোয়ার-ভাটা হতো। ফরিদপুর থেকে নদী দিয়ে বড় বড় মহাজনি নৌকা বাঘারপাড়ায় আসত। এর আগে নদীতে স্টিমার ও লঞ্চ চলত।

সরেজমিনে দেখা যায়, নদীতীরে শতাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও আবাসিক ঘরবাড়ি রয়েছে। নদীতে এখন কোথাও হাঁটুপানি, আবার কোথাও গভীরতা একটু বেশি। স্রোত আছে, তবে নিবু নিবু। স্থানে স্থানে জন্মেছে আগাছা ও কচুরিপানা। সেতুর ওপরে পূর্ব পাশে কংক্রিটের ঢালাই দেওয়া একটি বর্ধিত অংশ রয়েছে।

সেতুর উত্তর পাশে দুই দিকে রয়েছে ১০টি মাংসের দোকান। এসব দোকান থেকে মুরগি ও গরুর রক্ত, উচ্ছিষ্ট নাড়িভুঁড়ি, হাড়—এসব সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে নদীতে ফেলা হয়। এ ছাড়া পাশের একটি ক্লিনিকের নর্দমার মুখ নদীর ভেতরে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। দূষণে সেই পানির রং কালো হয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এ ছাড়া সেতুর দুই পাশে পলিথিন, ডিমের খোসা, মুরগির পচা নাড়িভুঁড়িসহ হরেক রকমের ময়লা-আবর্জনার স্তূপ রয়েছে।

নদীর পাশের বাসিন্দা আনোয়ার মেহেদী বলেন, নদীতে ময়লা-আবর্জনা ফেলায় রোদের তেজ বাড়লেই দুর্গন্ধ বাড়ে। নোংরা পরিবেশের কারণে মশা-মাছির উপদ্রব বাড়ছে। সংকীর্ণ সেতু তৈরি করে নদীর টুঁটি চেপে ধরা হয়েছে। নদীর দুই পার দখল হচ্ছে। নদী দখল রোধে ওয়াকওয়ে নির্মাণ এবং দূষণ রোধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বারবার দাবি জানানো হচ্ছে। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না।

নদীর পাশের মাংসের দোকানদার ওহিদুর রহমান বলেন, ‘সপ্তাহে দুই দিন বাঘারপাড়ার হাট। হাটের দিন দুই থেকে চারটি এবং অবশিষ্ট দিনে এক থেকে দুটি করে গরুই জবাই হয়। গরু জবাইয়ের জন্য পৌরসভার নিজস্ব কোনো স্থান নেই। এ জন্য ব্রিজের ওপর বর্ধিত যে জায়গা আছে, সেখানে আমরা গরু জবাই করি। রক্ত নদীর পানিতে পড়ে। কিন্তু নাড়িভুঁড়ি নদীতে ফেলা হয় না।’

চিত্রা বাঁচাও আন্দোলন বাঘাপাড়া উপজেলার আহ্বায়ক কোহিনুর আলম বলেন, নদীর প্রায় ২০০ অবৈধ দখলদার আছে। মাত্র ১২৬ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ছাড়া নির্বিচার বর্জ্য, ময়লা-আবর্জনা ফেলে নদীর পানি দূষিত করা হচ্ছে।