দারিদ্র্য বাধা হয়নি ওদের

সংসারের অভাব ঘুচিয়ে দেশের সেবা করার স্বপ্ন দেখে ওরা। শত কষ্টে পড়াশোনা করে সাফল্য পাওয়া চার অদম্য মেধাবীর গল্প নিয়ে এই আয়োজন।

দারিদ্র্যের কারণে প্রাইভেট-কোচিং করতে পারেনি। কারও মা-বাবা নেই। কেউ মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজছে এখানে-ওখানে। তারপরও পড়াশোনা থামায়নি ওরা। সেই কষ্টের ফল মিলেছে, সব বাধা কাটিয়ে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে তারা। সংসারের অভাব ঘুচিয়ে দেশের সেবা করার স্বপ্ন দেখে তারা। তবে কলেজে ভর্তি এবং পড়াশোনার খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তা কাটছে না তাদের।

সবার সহযোগিতায় মোজাম্মেলের সাফল্য

মা-বাবা নেই তার। নেই নিজস্ব কোনো ভিটেবাড়ি। থাকে বড় বোনের ভাড়া বাড়িতে। অদম্য এই ছেলে এবার চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার উত্তর রাঙ্গুনিয়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে।

মোজাম্মেলের বড় বোন লাকী আক্তার বলেন, মা-বাবা দুজনে মারা যাওয়ার পর তিনি ভাইকে দেখাশোনা করেন। রাউজানে তাঁর শ্বশুরবাড়ি হলেও, থাকার জায়গা না থাকায় রাঙ্গুনিয়ায় ভাড়া বাসায় থাকেন। তাঁদের আরেক ভাই রিকশা চালান। মোজাম্মেলের স্বপ্ন, একজন প্রকৌশলী হবে। কিন্তু আর্থিক অবস্থার কারণে স্বপ্নপূরণ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

মোজাম্মেল বলে, স্কুলের শিক্ষক, বড় বোন ও ভগ্নিপতির সহায়তায় এত দিন পড়ালেখা চালিয়ে গেছে। কিন্তু কলেজে পড়তে হলো অনেক টাকার দরকার। কীভাবে খরচ জোগাড় হবে, সেটাই এখন দুশ্চিন্তা।

মেধাবীদের পাশে দাঁড়াতে চায় নাসরীন

অনেক কষ্টে লেখাপড়া করে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে দিনমজুর বাবার মেয়ে জুনিয়া নাসরীন। তাই সে এই বয়সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর। এ জন্য সে জেলা প্রশাসক হতে চায়।

নাসরীন নীলফামারীর ডোমারের উত্তর খাটুরিয়া গ্রামের মো. জাকিরুলের মেয়ে। দুই বোনের মধ্যে সে বড়। ছোট বোন মুসফিকা জান্নাত অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। নাসরিনের মা মোছা. লাকী ইয়াছমিন বলেন, ‘মেয়ে ভালো ফলাফল করেছে, সে আরও পড়তে চায়। কিন্তু আমাদের পরিবারের সে সামর্থ্য নেই।’

পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পাওয়া জুনিয়া নাসরীন বলে, ‘আমার ইচ্ছা, ভালো কোনো কলেজে পড়ার। জেলা প্রশাসক হতে পারলে আমার মতো দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার দায়িত্ব আমি নেব।’

নটের ডেমে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে সুজয়

চর্মকার বাবা ও গৃহিণী মায়ের স্বপ্ন, দুই ছেলেকে পড়াশোনা করিয়ে ভালো মানুষ করবেন। বড় ছেলে সুজয় রবিদাস এগিয়ে চলেছে সেই স্বপ্নপূরণেই। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় সব কটি বিষয়ে জিপিএ-৫ পাওয়া সুজয় ঢাকার নটর ডেম কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। তবে সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অভাব।

নওগাঁর ধামইরহাট পৌরসভার চকযদু এলাকায় বাসিন্দা দুধনাথ রবিদাস ও চন্দনা রানী দম্পতির ছেলে সুজয় রবিদাস। দুধনাথ বলেন, ‘আমার ছেলে ভালোভাবে পাস করেছে, এতে আমি খুশি। সে ঢাকার কলেজে ভর্তির চান্স পেয়েছে। কিন্তু এখন শুনতেছি, সেখানে পড়তে মাসে নাকি অন্তত ২০ হাজার টাকা খরচ হবে। এই টাকা কোথা থেকে জোগাব আমি, তার কূলকিনারা করতে পারছি না।’

নম্বরের ভিত্তিতে জেলায় প্রথম এবং রাজশাহী বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করা সুজয় বলে, ‘আমি অভাবী পরিবারের সন্তান। তাই কষ্ট কী, আমি বুঝি। প্রকৌশলী হয়ে দেশের সেবা করার পাশাপাশি আমি গরিব বাবা-মায়ের দুঃখ ঘোচাতে চাই।’

কোচিং-প্রাইভেট ছাড়াই শামীমার সাফল্য

কোনো কোচিং কিংবা প্রাইভেট পড়ার সুযোগ পায়নি শামীমা আক্তার। তবে এসএসসিতে পেয়েছে জিপিএ-৫। মাধ্যমিকের ফরম পূরণের টাকা অন্যজনের সহযোগিতায় পরিশোধ করতে পারলেও অর্থাভাবে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে দরিদ্র বাবার অদম্য মেধাবী এই মেয়ে।

শেরপুরের নালিতাবাড়ীর নন্নী পশ্চিম পাড়া গ্রামের জেলে আবু সাঈদের মেয়ে শামীমা আক্তার। শামীমারা দুই বোন ও এক ভাই। বড় ভাই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স চতুর্থ বর্ষে এবং বড় বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় বর্ষে পড়ালেখা করেন। তিন সন্তানের লেখাপড়ার খরচ নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন সাঈদ। শামীমা আক্তার বলে, ‘আমার স্বপ্ন, বুয়েটে লেখাপড়া করে প্রকৌশলী হওয়ার। কিন্তু টাকার অভাবে খুবই হতাশায় থাকতে হয়।’

সাঈদ বলেন, ‘সামান্য আয়ে সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। দুবেলা পেট ভরে খেতে দিতে পারি না। মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মেয়েটার ফরম ফিলাপ করেছিলাম। এখন মেয়েকে কলেজে ভর্তি করাব কীভাবে?’

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন আব্বাস হোসাইন, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম, মীর মাহমুদুল হাসান, নীলফামারী, ওমর ফারুক, নওগাঁ আবদুল মান্নান, নালিতাবাড়ী, শেরপুর]