দিনরাত ধুলায় বসবাস

গত পাঁচ বছরের গড়ের তুলনায় সম্প্রতি হাসপাতালে শ্বাসকষ্টজনিত রোগীর সংখ্যা দুই-তিন গুণ বেড়েছে। এর বড় কারণ বায়ুদূষণ।

  • গত শুক্রবার বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে বস্তুকণা ছিল ২০৯ দশমিক ৪১ মাইক্রোগ্রাম।

  • বায়ুদূষণের কারণ সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি, শিল্পকারখানা ও ফিটনেসবিহীন যানের কালো ধোঁয়া।

সড়কে জমে থাকা ধুলাবালুর স্তর। যান চলাচলের সময় তা বাতাসে ওড়ে। সম্প্রতি গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মোগরখাল এলাকায় ঢাকা বাইপাস সড়কে
ছবি: প্রথম আলো

রাজধানীর উত্তরার আবদুল্লাহপুর পার হয়ে টঙ্গীতে প্রবেশ করলেই যানজটের পাশাপাশি ধুলায় দৃষ্টি ঘোলা হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। গাজীপুর শহরের দিকে এগোলে ধুলার ঘনত্ব আরও বাড়তে থাকে। চান্দনা থেকে গাজীপুর শহর, সব দিকেই যেন ধুলার রাজত্ব।

ধুলামাখা সড়ক পেরিয়ে গাজীপুর শহরে পৌঁছালেও এর হাত থেকে রেহাই মেলে না। দূষিত বাতাসের কারণে এখন প্রতিদিনই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে গাজীপুরের বাসিন্দাদের। গত শুক্রবারও গাজীপুরের বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা ছিল ২০৯ দশমিক ৪১ মাইক্রোগ্রাম। বায়ুতে এই পরিমাণ ধুলা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

জেলার টঙ্গী ও ধীরাশ্রম এলাকায় হাই ভলিউম এয়ার স্যাম্পলার মেশিন বসিয়ে প্রতিদিন বাতাসে ধূলিকণা পর্যবেক্ষণ করে পরিবেশ অধিদপ্তর। গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নয়ন মিয়া বলেন, গাজীপুরের বায়ুদূষণ এখন রাজধানী ঢাকাকেও পাল্লা দিচ্ছে। এক বছরের বেশি সময় ধরে ঢাকার চেয়েও দূষিত ছিল এই শহরের বায়ু।

প্রথমবারের মতো ৬৪ জেলার বায়ুদূষণের উৎস, পরিমাণ এবং ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেছে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়নকেন্দ্র (ক্যাম্পাস)। গত বছরের ৬ জানুয়ারি থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়, যা প্রকাশ হয় চলতি বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি।

গবেষণায় বায়ুদূষণের কারণ হিসেবে সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি, শিল্পকারখানা ও ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কালো ধোঁয়া ও ময়লা–আবর্জনা পোড়ানোকে চিহ্নিত করা হয়েছে। গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, গাজীপুরের বায়ুতে প্রতি ঘনমিটারে ২৬৩ দশমিক ৫১ মাইক্রোগ্রাম অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা পাওয়া গেছে।

গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নয়ন মিয়া বলেন, গাজীপুরে বায়ুদূষণের মূল কারণ বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড। বিআরটি কাজ বন্ধ হয়ে গেলে অর্ধেক বায়ুদূষণ কমে যাবে।

রাজধানীর বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর শহরের শিববাড়ী পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার সড়কে বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজ চলছে। ঢাকা বাইপাস সড়কেও শুরু হয়েছে উন্নয়নকাজ। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন এলাকায় উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড চলমান। বিআরটি প্রকল্পের কারণে চান্দনা চৌরাস্তা এলাকা এবং টঙ্গী এলাকায় বেশি খারাপ অবস্থা। এই এলাকায় দুই বেলা পানি ছিটানোর কথা থাকলেও তা নিয়মিত করা হয় না।

গাজীপুরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ও এর সঙ্গে যুক্ত সড়কে মোটরসাইকেল, রিকশা, বাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশার যাত্রীদের নানাভাবে ধুলার কবল থেকে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করতে দেখা যায়। বিভিন্ন স্থানে রাস্তার পাশের দোকানগুলো ঢাকা থাকে ত্রিপল দিয়ে। ধুলার আস্তরণ জমে থাকে রাস্তার পাশের ভবন, বাসাবাড়িতে।

মহানগরীর কুনিয়া বড়বাড়ি এলাকার বাসিন্দা জসিম উদ্দিন বলেন, তাঁর বাসাটা পড়েছে সড়কের পাশে। সেখানেই সন্তানদের নিয়ে বসবাস করেন। ধুলাবালুতে বাসাবাড়ির অবস্থা যেমন খারাপ হয়েছে, তেমনি ছেলেমেয়েরাও অসুস্থ হয়ে পড়ে।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়েছে প্রায় তিন বছর আগে। নির্বাচনে প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতি ছিল শহরকে দূষণমুক্ত করা। সেখানে বরখাস্তকৃত মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের স্লোগান ছিল, ‘গাজীপুর হবে গ্রিন ও ক্লিন সিটি।’ কিন্তু এই তিন বছরে শহর গ্রিন ও ক্লিন হওয়ার বদলে আরও দূষিত হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে ময়লার পাহাড়।

কোনাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা কামরুজ্জামান বলেন, একটি নগরীর অবস্থা কতটা খারাপ হলে ময়লা ফেলতে ফেলতে পাহাড়ের সৃষ্টি হয়। কড্ডা এলাকা দিয়ে নাক–মুখ বন্ধ করে যাতায়াত করতে হয়।

টঙ্গী সরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, গত পাঁচ বছরের গড়ের তুলনায় সম্প্রতি হাসপাতালে শ্বাসকষ্টের রোগীর সংখ্যা দুই-তিন গুণ বেড়েছে। এর বড় কারণ বায়ুদূষণ। গত জানুয়ারির শুরু থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জিসহ ঠান্ডাজনিত বিভিন্ন রোগে এই হাসপাতালে ৬২০ রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন।

গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, গত জানুয়ারি থেকে এই হাসপাতালেও শ্বাসকষ্টের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।

এসব বিষয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান বলেন, মহানগরীতে কীভাবে বায়ুদূষণ কমানো যায়, তা নিয়ে পরিকল্পনা চলছে। তবে মহাসড়কের উন্নয়নকাজ শেষ হলে দূষণের পরিমাণ কমে আসবে।