কাজের অপেক্ষায় বসে থাকা মজিরন বিবি। বৃহস্পতিবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জের টানবাজার থান কাপড় মার্কেটের সামনে
ছবি: প্রথম আলো

১৭ বছর ধরে রোজ সকালে শীতলক্ষ্যা পাড়ি দেন মজিরন বিবি (৪৬)। হেঁটে, রিকশায় চেপে অসুস্থ শরীর নিয়ে আসেন নারায়ণগঞ্জের টানবাজার থান কাপড়ের গলিতে। মহাজনদের ফুটফরমাশ খাটেন, থান কাপড় ভাঁজ করেন কিংবা দৈনিক মজুরিতে অন্য কোনো কাজ। দিন শেষে রোজগার নিয়ে ফেরেন বন্দরের ভাড়া বাড়িতে।

কয়েক দিন ধরে মজিরনের সেই চিরচেনা রুটিনে হেরফের হচ্ছে। শীতলক্ষ্যা পাড়ি দিচ্ছেন ঠিকই, তবে কাজ না পেয়ে ভরদুপুরেই বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরেও চোখেমুখে অসহায়ত্বের ছাপ নিয়ে কাজের অপেক্ষায় বসে ছিলেন থান মার্কেটের সামনে। সঙ্গে আরও কজন নারী। কথা হয় তাঁদের সঙ্গে।

কেউ কেউ ব্যক্তিগত দুঃখের কথা বলতে চান না। উল্টো প্রশ্ন করেন, ‘এসব বললে ঘরে ভাত যাইব, নাকি কাজ পামু?’ কেউ আবার গল্পের ঝাঁপি খুলে বসেন। তাঁদেরই একজন মজিরন বিবি।

১৮ বছর আগে স্বামী হারানোর পর থেকে এই থান কাপড়ের মার্কেটেই কাজ করছেন। কিডনি আর মেরুদণ্ডের রোগে ভুগছেন দুই বছর হলো। ঘরে মানসিক প্রতিবন্ধী ছেলে, স্বামীর ঘর ছেড়ে আসা মেয়ে ও চার বছরের নাতনি। চারজনের সংসারে মজিরন একা আয় করেন। দ্বিতীয় দফায় দেশে করোনার প্রকোপ বাড়ার পর সে আয়ের পথও বন্ধ হয়েছে তাঁর। তিনি বলেন, ‘আশা নিয়া গাঙ পার হই। সারা দিন বইসা থাইকা খালি হাতে ফিরা যাই। চাইরটা মানুষের খাওন, ঘরভাড়া, কিস্তি অনেক টেহার দরকার।’

গত বছরের লকডাউনের চেয়ে এবারের লকডাউনের সময়টাকে বেশি কঠিন মনে হয় মজিরনের কাছে। মানুষের কাছে ধারদেনা পেয়েছিলেন, ক্ষুদ্রঋণের কিস্তি নেওয়া বন্ধ ছিল, আশপাশের লোকজনেরও সহযোগিতা পেয়েছেন। এ বছর তেমনটা হচ্ছে না।

অভাবের কথা বলতে গিয়ে লজ্জায় হেসে ফেলেন মজিরন। বিড়বিড় করে বলেন, ‘কাম কইরা খাই, এসব শরমের কথা কওন যায় না। মাঝে মইধ্যে মনে হয় মুখে মাছি ঘুরতাছে। গেরামে ঘুইরা কচু-ঘেঁচুর হাগ (শাক) টোকাইয়া খাই। রোজা আইছে এক–আধটা খেজুর কিনতে ইচ্ছা হয়, পারি না।’ বলতে বলতেই দুর্বল শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়ান। এবার থেমে যেতে চান তিনি। ‘আপনার লগে প্যাঁচাল পাইড়া মাথা ঝিম মারতাছে। বইসা থাইকা দিন ফুরাই যায় কিন্তু কাম পাই না। আমাগোর চাইতে ভিক্ষুকরা ভালা, দিন শেষে খালি হাতে বাড়ি যাইতে হয় না। চল বুড়ি, বাড়ি যাই।’ বৃদ্ধা মরিয়মের দিকে তাকিয়ে তাড়া দেন মজিরন।

গ্রীষ্মের সূর্য তখন পশ্চিমে হেলতে শুরু করেছে। গলির মধ্যে তখনো বসে থাকেন বেকার হয়ে পড়া এমন আরও অনেক শ্রমিক। দুটো ভ্যানগাড়ি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। ক্লান্ত দুপুরে তার ওপর শুয়ে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেন কাজের অপেক্ষায় থাকা চালক।

মজিরনদের চলে যাওয়ার পর কথা বলেন বৃদ্ধা মর্জিনা, হালিমা আর তরুণী শিরিনা বেগমের মতো আরও কজন শ্রমিক। তাঁদের গল্পও বেকারত্ব আর অভাবের। তাঁদের মতো এমন অন্তত ৪০ জন নারী কাজ করেন টানবাজার থান কাপড় মার্কেটের বিভিন্ন দোকানে। গড়ে প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আয় করতেন। সে টাকায় সংসার চলত। দ্বিতীয় দফায় করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার পর এই নারীদের প্রায় প্রত্যেকেই কাজ হারিয়েছেন।

বেচাকেনা নেই, তবু লকডাউন অমান্য করে দোকানের ঝাঁপ খুলে বসেন দু–একজন মহাজন। বেচাকেনা হয় না। দুপুর পর্যন্ত কাজ না পেয়ে চোখেমুখে হতাশা নিয়ে বাড়ি ফেরেন কোনো কোনো শ্রমিক। যাঁরা বেশি আশাবাদী, তাঁরা দুপুর পেরিয়ে বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। এই শ্রমিকদের প্রত্যেকেই একটি কাজ চান। সম্মান নিয়ে খেয়ে–পরে বেঁচে থাকার মতো একটি কাজ।