‘দুই আসামির নাম বাদ দিবেন বলছিলেন, কথা রাখেননি...টাকা ফেরত দেন’

ফোনালাপ
প্রতীকী ছবি

মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েও হত্যা মামলার অভিযোগপত্র থেকে দুই আসামির নাম বাদ না দেওয়ার অভিযোগ তুলে তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে স্বজনের টাকা ফেরত চাওয়ার অডিও ছড়িয়ে পড়েছে। ফোনালাপের ওই অডিওতে আসামির স্বজনকে বলতে শোনা যায়, মামলাটি দুর্বল করতে দুই আসামির বিরুদ্ধে কম শাস্তিযোগ্য ধারার অভিযোগ আনা এবং আসামি থেকে দুজনের নাম বাদ দেওয়ার কথা ছিল। তবে তদন্ত কর্মকর্তা কথা না রাখায় তিনি তাঁর কাছে দুই দফায় দেওয়া ৮ লাখ ২০ হাজার টাকার মধ্যে ৭ লাখ টাকা ফেরত চাইছেন।

যে মামলায় তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে আসামির স্বজনের কথোপকথনের অডিও প্রকাশ পেয়েছে, সেটি গাইবান্ধার আলোচিত মামলা। গত বছরের ১০ এপ্রিল গাইবান্ধার আওয়ামী লীগ নেতা মাসুদ রানার বাসা থেকে ব্যবসায়ী হাসান আলীর লাশ উদ্ধারের ঘটনায় তিনজনকে আসামি করে মামলা হয়। নিহত ব্যক্তির স্ত্রী বীথি বেগম সদর থানায় মাসুদ রানা, শহরের স্টেশন রোডের জুতা ব্যবসায়ী রুমেল হক ও খলিলুর রহমানকে আসামি করে মামলাটি করেন। খলিলুর জামিনে এবং রোমেল পলাতক।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন গাইবান্ধা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. তৌহিদুজ্জামান। তিনি চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি মাসুদ রানা ও খলিলুর রহমানের নামে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ১৮ জানুয়ারি তিনি সুন্দরগঞ্জ থানার ওসি হিসেবে যোগ দেন। পরে আদালত সংশোধিত অভিযোগপত্র দেওয়ার নির্দেশ দেন। গাইবান্ধা কোর্ট পুলিশ ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে অভিযোগপত্রটি সংশোধনের জন্য বর্তমান তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে ফেরত পাঠায়। ৭ মার্চ মাসুদ রানাসহ তিন আসামিকেই অভিযুক্ত করে আদালতে সংশোধিত অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়।

ওসি তৌহিদুজ্জামানের সঙ্গে ফোনে আসামির স্বজনের পাঁচ দফায় প্রায় ১৭ মিনিট কথা হয়। ফোনালাপের সেই রেকর্ড প্রথম আলোর কাছে আছে। এর কিছু অংশ তুলে ধরা হলো—

আসামির স্বজন: স্যার, আমরা প্রথমে যে অ্যামাউন্ট দিছিলাম, ওটা আমাদের দরকার নাই। পরে দিছি সাত লাখ টাকা, এটা পুরাটাই দেন।
ওসি: তোমারে যা মনে করছিলাম, তুমি তো পুরাপুরি চেঞ্জ করে ফেলাইলা চেহারা। টোটালি ওটা তো নেওয়াই হয়েছে একজন আসামির জন্য। একজন আসামি বাদ দিলে...কথা হলো মূল ধারা বাদ দিয়ে দেব। এইটা হলো মূল। ওর (মাসুদ রানা) নামে দিছি ছয়টা ধারা আর তোমাগো নামে দেব দুইটা। তিন–চার ডেটে খালাস হবে। খালাস না হলে তখন আমার কাছ থেকে পুরোটা নিয়ে যাইয়ো, ঠিক আছে? আমার কাছে রইল তোমাদের আমানত।

আসামির স্বজন: দুই আসামির নাম বাদ দিবেন বলছিলেন, নাম না রাখার জন্য আমি টাকাটা দিলাম। সেই নাম থাকতেছে। কথা অনুযায়ী কাজ হয়নি। কথা রাখেননি। আমরা বড় উকিলের সঙ্গে বুঝছি। ৩৯২ ধারা দিছেন। সেটা তো দস্যুতা, ডাকাতি ধারা। প্রথমে বলছেন, দুজনের নাম থাকবে না। তারপর বলছেন একজনের নাম থাকবে। এখন আমার উপরে চাপ দিতেছে যে তুই স্যারেক বল টাকাটা দিয়ে দিক। আপনি বলছিলেন, কাজ না হলে টাকা ফেরত দিবেন, টাকা ফেরত দেন।
ওসি: তাহলে আমি ওই ধারাধুরা যা আছে, সব দিয়ে দেব। কিন্তু আগেরটা নিয়েছি, তোমাদের ডিস্টার্ব করব না, পরেরটা নিয়ে যাও।

আসামির স্বজন: টাকাটা আমার হাত দিয়ে দিছি। আপনি টাকাটা আমাদের কোন দিন দেবেন, সেটা বলেন। আপনি সব ধারা দেন, ৫১১টি ধারা সব দেন। আমার লোকজন জেল খাটতে রাজি। টাকাটা ফেরত দিয়ে যান।
ওসি: তুমি পুরা রেকর্ড করার জন্য ফোন দিছ। তুমি হাতে হাতে টাকা দিছ, তুমি এসে টাকা নিয়ে যাও।

আসামির স্বজন: রেকর্ড করার জন্য ফোন দেই নাই স্যার। রেকর্ড করলে তো আগেই করতে পারতাম। বাড়ির লোকজন বলতিছে, যদি টাকা না ওঠে, এসপি, ডিআইজি, আইজি—সব স্যারের কাছেই যাবে। মিডিয়াতে যাবে।

ওসি: এই ব্যাটা, আমারে ওই ভয় দেখাইয়া লাভ আছে?

আসামির স্বজন: আপনি তো বলছেন যে কাজ না হলে টাকা ফেরত দিবেন। আমরা তো সাত দিনের মধ্যে আপনাকে টাকা দিছি। এখন দুই দিনের মধ্যে ফেরত দিতে হবে।
ওসি: অবশ্যই দেব ফেরত। টাকা ভেঙে ভেঙে দেব।

আসামির স্বজন: স্যার, আমরা আগে যে অ্যামাউন্ট (১ লাখ ২০ হাজার) দিছিলাম, ওটা আমাদের দরকার নাই। এখন পরে আমরা সাত লাখ টাকা দিছি, এটা পুরাটাই চাচ্ছে। মহিলা মানুষ, বোঝেনই তো।
ওসি: তাহলে আমি ওই ধারাধুরা যা আছে, সব দিয়ে দেব। ঠিক আছে নিয়ে যাও। যা আছে, তা–ই দিয়ে দিতিছি। কিন্তু অফিশিয়াল ডে রোববার থেকে বৃহস্পতিবারের মধ্যে আসবা।

দুই আসামি রুমেল ও খলিলুরের স্বজনদের দাবি, তদন্তকারী কর্মকর্তা তৌহিদুজ্জামান মামলার অভিযোগপত্র থেকে এক আসামির নাম বাদ দেওয়া ও আইনের ধারা কমিয়ে দিতে দুই দফায় ৮ লাখ ২০ হাজার টাকা নেন। কিন্তু অভিযোগপত্রে প্রথমে একজন এবং পরে দুজনকেই অভিযুক্ত করা হয়।
টাকা নেওয়ার বিষয়ে তৌহিদুজ্জামানের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করে তাঁকে পাওয়া যায়নি।

গাইবান্ধা জেলা আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত উপদপ্তর সম্পাদক মাসুদ রানা। শহরের নারায়ণপুর এলাকায় তাঁর বাসা। তিনি দাদন ব্যবসা করতেন। প্রায় দুই বছর আগে রানার কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা ঋণ নেন শহরের স্টেশন রোডের জুতা ব্যবসায়ী হাসান আলী। এই টাকা সুদ–আসলে ১৯ লাখে দাঁড়ায়। সুদের টাকা দিতে না পারায় গত বছরের ৬ মার্চ লালমনিরহাট থেকে হাসানকে মোটরসাইকেলে করে তুলে আসেন মাসুদ। তিনি হাসানকে নিজের বাসায় এক মাসের বেশি আটকে রেখেছিলেন। লাশ উদ্ধারের ঘটনার দিনই মাসুদ রানাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তিনি বর্তমানে জেলা কারাগারে আছেন।