দুই জোড়া শখের কবুতরে শুরু, ফাহিমের মাসিক আয় ৭০ হাজার টাকা

নিজের পোষা কবুতর ও পাখিদের সঙ্গে শাহরিয়ার ফাহিম। সোমবার মৌলভীবাজারের বড়লেখা পৌরসভার পাখিয়ালা এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

দুই জোড়া শখের কবুতর পোষার মধ্য দিয়ে শুরুটা করেছিলেন মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার মো. শাহরিয়ার ফাহিম। এখন ভোর থেকেই ফাহিমদের বাড়িজুড়ে শোনা যায় শত শত কবুতরের ডাক। সন্ধ্যায়ও থাকে এমন সরব মুখরতা। নানা রঙের কবুতর একদিকে যেমন আনন্দের কারণ, অন্যদিকে হয়ে উঠেছে আয়েরও উৎস।

ফাহিম বড়লেখা পৌরসভার পাখিয়ালা এলাকার মৃত মো. আবদুল মতিনের ছেলে। বড়লেখা ডিগ্রি কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেছেন তিনি। তিন ভাইবোনের মধ্যে বড় ফাহিম কবুতর পোষার আয় দিয়ে শুধু শখই পূরণ করেননি, পড়ালেখার খরচ চালিয়েছেন, ধরেছেন সংসারের হাল। এই আয় দিয়েই দিয়েছেন পশুপাখির খাদ্য ও ওষুধের দোকান। এসব থেকে ফাহিমের মাসিক আয় আসে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। তাঁকে দেখে এলাকার অনেকেই এখন কবুতর পুষতে শুরু করেছেন।

আজ মঙ্গলবার পাখিয়ালা এলাকায় শাহরিয়ার ফাহিমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, দোতলা ভবনের ছাদের দুই পাশে কাঠ ও তারের জাল ঘেরা দুটি টিনের ঘরে অনেকগুলো কবুতর ও বিভিন্ন জাতের পোষা পাখি। বাড়িতে ঢোকার পথে দুটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দিয়েছেন ফাহিম। একটি স্টেশনারি এবং অন্যটি পাখিখাদ্য ও ওষুধের। এই কবুতর, পাখি ও এসবকেন্দ্রিক ব্যবসাকে ঘিরেই তাঁর জীবন কাটছে।

ফাহিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি কখনো বেকার থাকতে চাইনি। যে কারণে নবম শ্রেণিতে থাকতেই লেখাপড়ার পাশাপাশি ব্যবসা শুরু করি। কবুতর পোষার শখ ছিল। কিন্তু এখন এটা আমার আয়ের বড় উৎস। এই আয় থেকে আমার পরিবার চলে। এগুলো পুষলে খারাপ নেশায় যুক্ত হওয়ার সময়-সুযোগ থাকে না। যেকোনো ক্ষতিকর নেশা থেকে দূরে থাকতে কবুতর পালন একটি সুন্দর বিকল্প।’

করোনার আগে আয় আরও বেশি ছিল জানিয়ে শাহরিয়ার ফাহিম বলেন, বাবার মৃত্যুর পর নিজে কিছু একটা করার ভাবনা মাথায় আসে তাঁর। বাসাসংলগ্ন নিজেদের জমিতে কয়েকটি দোকানঘর ছিল। পাশেই একটি কেজি স্কুল। ওই দোকানঘরের একটি কক্ষে ২০১২ সালে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করেন স্টেশনারি পণ্যের ব্যবসা। একসময় এসএসসি পাস করেন। তত দিনে কারও কাছে হাত না পেতে নিজের মতো ভাবার সুযোগ তৈরি হয়েছে তাঁর।

শখের বশে ২০১৪ সালে দুই জোড়া কবুতর কেনেন ফাহিম। তিনি বলেন, যৌথ পরিবারে কবুতর পোষায় অন্যদের সমর্থন ছিল না। বন্ধুদেরও কেউ কেউ ঠাট্টা-মশকরা করেছেন। এরপরও ধৈর্য ধরে ব্যবসা ও পড়াশোনার পাশাপাশি কবুতর লালন-পালন করতে থাকেন। একদিন কবুতর ডিম দিল, ডিম ফুটে বাচ্চা হলো। বাড়তে থাকল সংখ্যা। বাড়ল কবুতর সম্পর্কে জানার আগ্রহ। রেসের কবুতরসহ নানা জাতের দামি কবুতরের খোঁজ পেলেন। তখন বড়লেখায় বড় পরিসরে কবুতর পুষতেন না কেউ। বাণিজ্যিকভাবে তো নয়ই। সিলেট, বিয়ানীবাজার, ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা নতুন জাতের আরও কিছু কবুতর এসে যোগ হলো তাঁর সংগ্রহে। এর সঙ্গে যোগ করলেন বিভিন্ন জাতের পোষা পাখিও।

বাণিজ্যিকভাবে কবুতর পোষার বিষয়ে জানতে চাইলে শাহরিয়ার ফাহিম বলেন, মানুষের মধ্যে জানাজানি হলো। অনেকে কবুতর দেখতে আসে। অনেকে নিতেও আসে। তখনই কবুতর নিয়ে ব্যবসার চিন্তা আসে। পরিবারে যাঁদের আপত্তি ছিল, তাঁরাও আর বাধা দিলেন না।

শাহরিয়ার ফাহিমের খামারে বর্তমানে ২০ জাতের প্রায় ৭০০ কবুতর আছে। যাঁর বর্তমান বাজারমূল্য আট থেকে নয় লাখ টাকা। এর মধ্যে ফেনসি, রেসার, গিরিবাজ কবুতরের চাহিদা যেমন, সংখ্যাও বেশি। তাঁর খামারের এক জোড়া কবুতরের দাম দেড় হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত। বাজরিগর, ককাটিয়েল, অস্ট্রেলিয়ান ঘুঘুসহ আট প্রজাতির পোষা পাখি রয়েছে ফাহিমের খামারে।

শাহরিয়ার ফাহিমের খামারের কবুতর
ছবি: প্রথম আলো

ফাহিম জানান, কবুতরের ব্যবসা থেকে পরিবারের খরচ চালিয়েছেন। এই আয় থেকেই পশুপাখির খাদ্য ও ওষুধের দোকান দিয়েছেন। দুটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালানোর পাশাপাশি নিজে স্নাতক পাস করেছেন। দুই বোন পড়ছেন কলেজে।

স্থানীয় তরুণদের কাছে অনুকরণীয় উদ্যোক্তা হিসেবে শাহরিয়ার ফাহিমের পরিচিতি তৈরি হয়েছে। তাঁকে দেখে অনেকেই কবুতর পোষায় আগ্রহী হয়েছেন। এ বিষয়ে অনেককে পরামর্শ ও সহযোগিতা করেন তিনি। কবুতর পোষার বিষয়ে কোনো প্রশিক্ষণ নেননি জানিয়ে ফাহিম বলেন, লালন-পালন করতে গিয়েই শিখে নিয়েছেন কবুতর ও পাখির মনমেজাজ, কোন আবহাওয়ায় কোন ধরনের সতর্কতা ও যত্ন দরকার। নিজেই গম, ভুট্টা, সবুজ মুগ, সূর্যমুখী, ধান, বাদাম, ছোলা, কাজরা, চিনা ইত্যাদি কিনে খাদ্য তৈরি করেন। বর্তমানে কবুতর, পাখি ও ব্যবসা থেকে তাঁর মাসিক আয় ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা।

উপজেলার পাথারিয়া গাংকুল মনসুরিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার প্রভাষক ও পানিধার গ্রামের বাসিন্দা সঞ্জীব সরকার বলেন, ‘কবুতর পোষার শখ ছিল। ফাহিমের খামার দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে শখকে বাস্তবে রূপ দিয়েছি। এক বছর হলো বাড়ির ছাদে কবুতর পালন শুরু করেছি। বর্তমানে আমার ৩০-৩৫ জোড়া দেশি ও ফেন্সি কবুতর রয়েছে। ওনার দোকান থেকেই পাখির খাবার কিনি।

শাহরিয়ার ফাহিমের খামার দেখে কবুতর পালনে আগ্রহ তৈরি হয়েছে পূর্ব পাখিয়ালা গ্রামের মাদ্রাসাশিক্ষার্থী আফজাল শাহিদ ও লাইসিয়াম স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আফসার হোসেনেরও। তারা জানিয়েছে, কয়েক মাস ধরে কবুতর পালন করছে তারা। ফাহিমের কাছ থেকেই কবুতর লালন-পালন, চিকিৎসাসহ সব ধরনের প্রয়োজনীয় পরামর্শ নেয়।

বড়লেখা উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মুহাম্মদ তাজ উদ্দিন বলেন, ‘ফাহিমের এমন কর্মস্পৃহা দেখে আমার ভালো লাগে। ওর বয়সের অনেক তরুণ নানান অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে সে ব্যতিক্রম। লেখাপড়া করছে। পাশাপাশি কবুতর পালন করে নিজে সাবলম্বী হয়েছে। অন্য তরুণেরাও যদি তাঁর মতো লেখাপড়ার পাশাপাশি এভাবে গবাদিপশু-পাখি পালন করেন, তাহলে দেশে বেকারত্ব কমবে। অপরাধ কমবে।’