দুই পক্ষের বিরোধ প্রকাশ্যে, ২০ নেতার আবেদন

নগরের ৩০টি ওয়ার্ড কমিটি বিলুপ্ত করায় মাঠ নেতাদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে।

সদ্য গঠিত বরিশাল নগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি নিয়ে দুটি পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিভক্তি ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। মহানগর বিএনপির সদ্য গঠিত আহ্বায়ক কমিটি গঠন এবং সম্প্রতি ৩০টি ওয়ার্ড কমিটি ভেঙে দেওয়াকে কেন্দ্র এই দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে চলে এসেছে। গত বুধবার সদ্য গঠিত নগর কমিটি থেকে বাদ পড়া নেতারা কী কারণে সদ্য গঠিত আহ্বায়ক কমিটি থেকে বাদ পড়েছেন, তার ব্যাখ্যা চেয়ে আবেদন করেছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মাধ্যমে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে এই আবেদন করেন মহানগর বিএনপির আগের কমিটির শীর্ষ ২০ নেতা। বিএনপির বরিশাল বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস আক্তার জাহানের সঙ্গে দেখা করেও এই আবেদনের অনুলিপি দিয়েছেন তাঁরা। বিলকিস আক্তার জাহান গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

ওই আবেদনে বঞ্চিত নেতারা অভিযোগ করেছেন, ‘সম্প্রতি বরিশাল মহানগর বিএনপির ৪১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটির ২০ জনকেই আমরা চিনি না। তাঁরা গত ১০-১২ বছরে দলীয় কোনো কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত ছিলেন না। অথচ সেই সব ব্যক্তিকে আহ্বায়ক কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু মহানগর বিএনপির বিলুপ্ত করা ১৭১ সদস্যের কমিটিতে যেসব নেতা ১০ বছর ধরে বর্তমান অগণতান্ত্রিক-অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করে নির্যাতন-কারাভোগ, হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন, সেই সব নেতাকে সদ্য গঠিত আহ্বায়ক কমিটিতে রাখা হয়নি। এসব ত্যাগী নেতাকে কেন আহ্বায়ক কমিটিতে রাখা হয়নি, তার ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে ওই আবেদনে।

আবেদনকারী নেতাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক সহসভাপতি আব্বাস উদ্দীন, সৈয়দ হাসান, মো. আলম, যুগ্ম সম্পাদক সৈয়দ আকবর, আইনজীবী ফোরামের সভাপতি মহসিন মন্টু, সাবেক সহসাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হক, আইনজীবী মো. শহিদ অন্যতম।

একই সঙ্গে সম্প্রতি নতুন আহ্বায়ক কমিটির নেতারা মহানগর বিএনপির ৩০টি ওয়ার্ড কমিটি কোনোরকম আলাপ-আলোচনা ছাড়াই আকস্মিক ভেঙে দেওয়ার বিষয়টি নিয়েও অভিযোগ করেছেন।

দলীয় সূত্রে জানা যায়, বরিশাল মহানগর বিএনপির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমানের নেতৃত্বাধীন ১৭১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ভেঙে দিয়ে গত বছরের ৩ নভেম্বর আহ্বায়ক কমিটির অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় বিএনপি। কমিটিতে মনিরুজ্জামান খানকে আহ্বায়ক, আলী হায়দারকে এক নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক ও মীর জাহিদুল কবিরকে সদস্যসচিব করা হয়। এরপর গত ২২ জানুয়ারি ৪১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদন করা হয়। সেখানে আগের ১৭১ সদস্যের কমিটির গুরুত্বপূর্ণ নেতারা স্থান পাননি।

এর আগে পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটির জন্য কেন্দ্রে নাম জমা দেওয়ার পর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তা নিয়ে আপত্তি তোলেন মহানগরের আগের কমিটির অন্তত ৩১ নেতা। তাঁরা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। কিন্তু তাঁদের আবেদন আমলে নেওয়া হয়নি।

বিএনপি একটি বড় দল। এখানে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে কিছু ভুল-ত্রুটি থাকতেই পারে। যেকোনো কমিটিতে যোগ্য-ত্যাগী কেউ বাদ পড়তে পারে, আবার সেগুলো সংশোধনেরও সুযোগ আছে।
বিলকিস আক্তার জাহান, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, বিএনপি

বরিশাল মহানগর বিএনপি ২০ বছরের বেশি সময় ধরে আবর্তিত হয়েছে মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি মজিবর রহমানকে কেন্দ্র করে। তিনি একাধারে দলের নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি ছিলেন বেশ কয়েকবার সদর আসনের সাংসদ, জাতীয় সংসদের হুইপ এবং বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র। তাঁর নেতৃত্বে থাকা নগর কমিটি ভেঙে দেওয়ার পর যাঁদের নিয়ে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে, তাঁরা নগর বিএনপির রাজনীতিতে মজিবরবিরোধী হিসেবে পরিচিত।

নগর বিএনপির সাবেক সহসাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হক বলেন, ‘মজিবর রহমান নগর বিএনপির রাজনীতির প্রাণপুরুষ ছিলেন, এটা সত্য। দলের হাইকমান্ড তাঁকে নেতৃত্ব দিয়েছিল। আমরা সবাই তাঁর নেতৃত্বে দলের দুর্দিনে ছিলাম। আমাদের কী অপরাধ? রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রামে নিবেদিত নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়ে নিষ্ক্রিয়-সরকারি দলের সঙ্গে ভাগ-বাঁটোয়ারার সঙ্গে জড়িতদের নিয়ে আহ্বায়ক কমিটি করা হলো। আমরা সেটারই ব্যাখ্যা চেয়েছি।’

ওয়ার্ডে পাল্টা কমিটি গঠনের হুমকি

বরিশাল মহানগরের ৩০টি ওয়ার্ড কমিটি বিলুপ্ত করায় মাঠ নেতাদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে। ওয়ার্ড পর্যায়ের প্রায় ১০ জন নেতার সঙ্গে কথা হলে এ নিয়ে তাঁরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সদ্য বিলুপ্ত ২২ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘৩৬ বছর ধরে দল করছি। এই সরকারের আমলে রাজপথে আন্দোলন করে ২৪টি মামলার আসামি হয়েছি। আমাকে বলা হয়েছে নিষ্ক্রিয়। বর্তমান মহানগরের নেতাদের এমন স্বেচ্ছাচারিতায় ওয়ার্ড পর্যায়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা পাল্টা ওয়ার্ড কমিটি করে কেন্দ্রে পাঠাব। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আমাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবেন।’

এ বিষয়ে মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব মীর জাহিদুল কবির বলেন, নগরের ৩০টি ওয়ার্ড কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে অনেক আগে। কমিটির বেশির ভাগ নেতা সাংগঠনিকভাবে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। কেউ কেউ মারা গেছেন। তাই গত শুক্রবার রাতের সভায় সর্বসম্মতিক্রমে ৩০ ওয়ার্ড কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। এসব সভায় সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করা হবে।

সার্বিক বিষয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস আক্তার জাহান প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি একটি বড় দল। এখানে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে কিছু ভুল-ত্রুটি থাকতেই পারে। যেকোনো কমিটিতে যোগ্য-ত্যাগী কেউ বাদ পড়তে পারে, আবার সেগুলো সংশোধনেরও সুযোগ আছে।