দুই হাত, দুই পা হারালেও মনোবল হারাননি জব্বার

ফার্মেসিতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন আবদুল জব্বার
ছবি: প্রথম আলো

১৪ ফুট দৈর্ঘ্য আর ৮ ফুট প্রস্থের কক্ষটির তিন পাশে ইটের দেয়াল, ওপরে টিনের চাল। কক্ষের তিনটি কাঠের আলমারিতে থরে থরে সাজানো বিভিন্ন ওষুধ। মাঝখানে ফোমের চেয়ারে বসা এক প্রৌঢ়। তাঁর দুই হাত কনুই থেকে ও দুই পা হাঁটু থেকে নেই।

ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার আজিমনগর ইউনিয়নের শিমুলবাজারের এ দোকানের নাম আল-আমিন ফার্মেসি। চেয়ারে বসে থাকা ব্যক্তিটি হলেন জব্বার হাওলাদার (৫৯)। সবাই তাঁকে চেনেন পল্লিচিকিৎসক হিসেবে। এলাকার মানুষের জ্বর, ঠান্ডা, হাঁচি-কাশি, খুঁজলি, অ্যালার্জি, পেটের পীড়া বা মাথাব্যথাসহ ছোটখাটো সব রোগের সমাধান মেলে জব্বারের দেওয়া ওষুধে। রোগীর ব্যবস্থাপত্রের জন্য কোনো টাকা নেন না জব্বার। ওষুধও কেনা যায় ওই ফার্মেসি থেকেই।

আবদুল জব্বারও আর দশজনের মতো স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে উঠেছেন। কিন্তু গ্যাংগ্রিনে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ১০ বছরের ব্যবধানে ২১ বার শল্যচিকিৎসকের ছুরি-কাঁচির নিচে যেতে হয়েছে তাঁকে। অস্ত্রোপচার করে একে একে দুই হাত ও দুই পা কেটে ফেলা হয়েছে। তবে জীবনের কঠিন সময়েও মনোবল হারাননি তিনি, কারও মুখাপেক্ষীও হননি। নিজের চেষ্টায় বিভিন্ন ডিগ্রি অর্জন করে পল্লিচিকিৎসক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

ফরিদপুর শহর থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে ভাঙ্গা চৌরাস্তা। সেখান থেকে এক্সপ্রেসওয়ে ধরে ঢাকার পথে ১৬ কিলোমিটার এগোলে পুলিয়া বাজার। এ বাজার থেকে দক্ষিণে চার কিলোমিটার গেলে শিমুলবাজার। বিভিন্ন পণ্যের তিন শতাধিক দোকান রয়েছে সেখানে। ওষুধের দোকান রয়েছে অন্তত ১০টি। এরই একটি জব্বারের আল–আমিন ফার্মেসি। সম্প্রতি সেখানে গিয়ে কথা হয় জব্বার হাওলাদারের সঙ্গে।

১৯৮৬ সালের কোনো একদিন। ছোট ভাই জলিল হাওলাদারের পাখি রাখার খাঁচা বানাতে বাঁশ কাটছিলেন জব্বার। অসাবধানতাবশত ডান পায়ের বৃদ্ধ আঙুলে দায়ের কোপ লেগে সামান্য কেটে যায়। পরে ইনফেকশন (সংক্রমণ) দেখা দেয়। ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল (বর্তমানে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) চিকিৎসা নেন। ওষুধ খান। কাজ হয় না। তাঁর গ্যাংগ্রিন (পচনশীল ক্ষত) সংক্রমণ বাড়তে থাকায় ১৯৮৭ সালে ডান পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলিসহ পাশের আঙুল দুটি কেটে ফেলতে হয়।

১৯৯৫ সালের শুরুর দিকে ডান হাতের তর্জনী ও বৃদ্ধ আঙুলে ঘা দেখা দেয়। পরে সে ঘা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে একের পর এক আঙুল থেকে অন্য আঙুলে। কবজি ও হাঁটু পর্যন্ত ঘা দেখা দেয়। ১৯৯৫ সালে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২১তম অস্ত্রোপচার করে তাঁর দুই পা হাঁটু থেকে এবং দুই হাত কনুই থেকে কেটে ফেলা হয়।

আলাপকালে জব্বার জানান, চিকিৎসায় তাঁর ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৩ লাখ টাকা। প্রতিবন্ধী হওয়ার পরও তিনি থেমে থাকেননি। তিনি চাননি কারও মুখের দিকে চেয়ে থাকতে। শত প্রতিকূলতার মধ্যে চেষ্টা করেছেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে, কর্মসংস্থানে আত্মনিয়োগ করতে। জব্বার বলেন, ‘যারা অল্পতে ভেঙে পড়ে বা সুযোগ পেলেই অন্যের সাহায্য-সহযোগিতায় চলতে পছন্দ করে, তাদের সম্পর্কে আমি বলতে চাই, আত্মসম্মান জীবনের সবচেয়ে বড় অলংকার আর মনোবল হলো যেকোনো খারাপ পরিস্থিতি মোকাবিলার অস্ত্র।’

১৯৯৯ সালে জব্বার পুলিয়া বাজারের রোকন আকন্দের মালিকানাধীন আল-আমিন ফার্মেসিতে ওষুধ বিক্রির কাজ শেখা শুরু করেন। ২০০৯ সাল পর্যন্ত ওষুধের নাম মুখস্থ করা, বিক্রির পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন। এর ভেতরেই ২০০২ সালে তিনি ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকার লোকাল হেলথ অ্যান্ড পিপলস ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি থেকে ছয় মাস মেয়াদি এলএমএএফ (লোকাল মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যান্ড ফ্যামিলি প্ল্যানিং) পাস করেন।

জব্বারের কাজে সব সময় ছায়ার মতো থেকে সার্বিক সহায়তা করেছেন তাঁর স্ত্রী হেলেনা বেগম (৫২)। ওষুধের ব্যবস্থাপত্র লেখেন পল্লিচিকিৎসক জব্বার আর রোগীদের ওষুধ দেন হেলেনা। তিনি বলেন, প্রতিদিন প্রায় ৬০-৭০ জন রোগী এখানে ছোট ছোট বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসেন। সব মিলিয়ে দিন এখন ভালো যাচ্ছে।

আজিমনগরের চকলারপাড় গ্রামের বাসিন্দা কৃষক শাহাবুদ্দিন মাতুব্বর (৭৫) বলেন, জব্বারের ফার্মেসি এ বাজারে আছে বলে ছোটখাটো সমস্যায় ভাঙ্গা কিংবা ফরিদপুর যেতে হয় না। এখানেই ডায়াবেটিস, প্রেশার মাপা, জ্বর, মাথাব্যথাসহ অনেক রোগের ওষুধ পেয়ে থাকেন।

ভাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মহসিন উদ্দিন ফকির বলেন, পল্লিচিকিৎসক জব্বারের কথা তিনি শুনেছেন। নিজের অদম্য প্রচেষ্টা ও কর্মদক্ষতায় তিনি আজ স্বাবলম্বী। জব্বার অবশ্যই সবার কাছে একটি উদাহরণ।