দেনা শোধের চিন্তায় কামরুলের মুখে খাবার রুচে না

খুব ছোট বয়সেই দাদা-বাবার সঙ্গে সমুদ্রে গিয়ে মাছ ধরতেন বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার জেলে কামরুল খান
ছবি: প্রথম আলো

‘অভাব দেখছি ছোটবেলা দে। বাপ গাঙে মাছ ধরত। তহন দে গাঙ চিনছি। সেই পাঁচ থেকে ছয় বছর বয়াসের তে এই গাঙে জাল-পালা বাই। কিন্তু অভাব সারে না। টাহা-পুঁজি নাই। জাল নৌকা গড়াতি একবার এলাকার এক দাদন ব্যবসায়ীর দে টাহা নিছিলাম। গা’র ওজনে সুদ দিছি, কিন্তু টাহা শ্যাষ হয় না।’ বড় আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন জেলে মো. কামরুল খান। বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার মাদারদিয়া গ্রামে নদীর পাড়ে তাঁর ঘর। দাদা-বাবার ধারায় দড়াটানা নদীতে মাছ ধরার পেশা বেছে নিয়েছেন তিনি; কিছু বুঝে ওঠার আগের বয়স থেকে।

অভাব ঘোচাতে একটু বড় হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন সাগরে। থেকেছেন সুন্দরবনের বিচ্ছিন্ন দ্বীপের শুঁটকি পল্লিতে। কিন্তু মুক্তি মেলেনি অভাব থেকে।

গতকাল রোববার ভোরে কামরুল খানের সঙ্গে দেখা রামপাল উপজেলার মল্লিকের বেড় ইউনিয়নের মাদারদিয়া রাস্তার মাথায়। সারা রাত নদীতে জাল পেতে কিছু ঘুষো আর চামি চিংড়ি পেয়েছেন তিনি। লোকজনের আনাগোনা শুরুর আগে সেখানকার নদী ঘাটে কিছুটা ভয়ে ভয়ে খেয়া ভেড়ান। সারা রাত ধরে পাওয়া তাঁর মাছগুলো বিক্রি হয় ৭০০ টাকায়। কিন্তু কপাল থেকে চিন্তার ভাঁজ নামেনি কামরুলের। দুই দিনের মধ্যেই কিস্তির টাকা দিতে হবে। কিন্তু এই টাকায় বাজার করবেন, খাবেন, নাকি অন্য কিছু করবেন, তা বুঝতে পারছেন না তিনি।

কামরুল বলেন, ‘৮-৯ লাখ টাকা দেনা কইরে এবার সাগর করতে (মাছ ধরতে) গেছিলাম। দুবলার চরে শুঁটকির ঘরে মোটামুটি এবার ভালোই হচ্ছিল। কিন্তু কপালে না থাকলি কী হইবে কন? সাড়ে তিন মাসও সাগর করতে পারলাম না। হঠাৎ এক ঝড়ে সাগরে আমার ট্রলার ডুইবে গেল। আর পাইলাম না। ১০ জন জাইলে (জেলে) লইয়ে ফিরে আইতে হলো। দেনার টাহা মাত্র কিছু শোধ দিতেছিলাম। কিন্তু সব শ্যাষ হইয়ে গেল। এখনো ৭-৮ লাখ টাহা দেনা।’

কামরুলের মতো শত শত জেলে শুঁটকি মৌসুমে (নভেম্বর-মার্চ) সুন্দরবনের দুবলার চরে অস্থায়ী ঘরে থাকেন। ঋণ করে টাকা নিয়ে যান। মাছ বিক্রি ভালো হলে সুদ-দেনা পরিশোধ করে কিছু থাকে। তা না হলে পড়তে হয় ঋণের জালে।

নৌকা নিয়ে মল্লিকের বেড় লঞ্চ ঘাটে ভিড়েছেন জেলে কামরুল
ছবি: প্রথম আলো

কামরুল এবার শুঁটকির মৌসুমে একটি এনজিও থেকে তিন লাখ ও স্থানীয় লোকজনের থেকে চড়া সুদে পাঁচ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ট্রলার, জাল মেরামত করে দুবলার চরে যান। কিন্তু ঝড়ে ট্রলার ডুবে যাওয়ায় সবাইকে নিয়ে ফিরতে হয়েছে খালি হাতেই। ট্রলার ডোবার আগ পর্যন্ত যে শুঁটকি বিক্রি করছেন তা দিয়ে ধারের কিছু টাকার কিস্তি আর সঙ্গে যাওয়া জেলে-শ্রমিকদের বেতন দিয়েছেন। কিন্তু মৌসুম শেষ করতে না পারায় ঘাড়ে চেপেছে ঋণের বোঝা। সঙ্গে যোগ হয়েছে ট্রলার-জাল হারানোর ক্ষত।

এরপরও কীভাবে চলছে, সেই প্রশ্নে কামরুলের সরল উত্তর, ‘জাইলে গো সংসার, একটু কষ্ট তো হবে। এর নামই জাইলে–জীবন।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখন তো অবরোধ চলে। নদীতে জাল-পালা বাওয়া (মাছ ধরা) নিষেধ। তারপরও গাঙে নামতি হচ্ছে। সাধে কি আর কেউ নামে কন? মাথার ওপর সংসার। চারটা ছেলে-মে। মাইয়েডা বিয়ে দেওন লাগবে। ঋণের টাকা, সুদ বাড়তি থাকপে। বাজার-ঘাটে গেলি, কোথাও দোকানে বসলিও টেনশনে কিছু খাই না। কীভাবে কি করব? দেনা শোধ কী করে দেব।’