‘দেনা শোধ হলে গ্রামের বাড়ি চলে যাব’

ফুটপাতে চৌকিখাট তৈরির করছেন মানিক হাওলাদার ও আব্দুর রহমান
ছবি: প্রথম আলো

মানিক হাওলাদারের বয়স ৩৫ বছর। আসবাবপত্র তৈরির জগতে পা রেখেছেন সাত বছর বয়সে। এরপর দিনে দিনে সহযোগী থেকে পুরোদস্তুর কাঠমিস্ত্রি হয়ে উঠেছেন। অন্যের দোকানে কাজ করতে করতে একসময় নিজেই দোকানমালিক হয়েছিলেন। তবে ব্যবসার কঠিন হিসাব–নিকাশে পরাস্ত হয়ে সেই পাঠ চুকাতে হয়েছে। ফের কাজ করছেন অন্যের দোকানে।

অল্প এই বয়সে মুদ্রার দুই পিঠই দেখা ফেলা মানিক হাওলাদারের সঙ্গে আজ শুক্রবার সকালে আলাপ জমে। খুলনার পশ্চিম রূপসার খানজাহান আলী সড়কের ‘শ্রম ভবনের’ সীমানা প্রাচীরের ঠিক বাইরের ফুটপাতে তিনি চৌকিখাট তৈরির করছিলেন।

করাত টানতে টানতে মানিক বলেন, ‘সাত বছর বয়স থেকে দুলাভাইয়ের সঙ্গে এখানে কাজে আসতাম। সহযোগিতা করতে করতে এই কাজ শিখছি। কাজের ফাঁকে স্কুলে যেতাম। ক্লাস ফাইভের পর আর পড়ালেখা হয়নি।’

মানিকের গ্রামের বাড়ি ছিল পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া। বাবা দীর্ঘকাল খুলনা শহরে কাজ করার পর এখন থিতু হয়েছেন বাগেরহাটের মোংলার মিঠেখালীতে। মানিক তাঁর স্ত্রী আর ছয় বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে থাকেন খুলনা শহরে। সকাল থেকে রাত অবধি কাজ করে ৪০০ টাকার মতো আয় হয়। এ আয় দিয়ে অনেক কষ্টে সংসার চালাতে হচ্ছে।

মানিক বলেন, ‘যা আয় তা দিয়ে সংসার চলে কীভাবে, বোঝেন তো! সবাই তো ৮ ঘণ্টা কাজ করে, আমরা ১৫–১৬ ঘণ্টা কাজও করি। এখান থেকে কাজ শেষ করে সন্ধ্যার পর অন্য দোকানেও ক্ষ্যাপ খাটি। না হলে তো বাঁচার কায়দা থাকে না। আমার যখন বুজ হইছে, তখন চাল খাইছি সাড়ে সাত-আট টাকা কেজি। এখন সেই চাল ৫০–৬০ টাকা কিনতেছি। তাইলে কীভাবে চলবে।’

সম্প্রতি প্রায় সব নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানিকদের মতো খেটে খাওয়া মানুষ বিপাকে পড়েছে। এখন অনেক হিসাব করে বাজার করতে হয় বলে জানালেন মানিক। তিনি বলেন, ‘কোনো রকম এদিক সেদিক করার সুযোগ নাই। সকালে পান্তা আর মরিচ দিয়ে খাই। কম তেল লাগে এমন রান্না হচ্ছে। মাছ খাই না কত দিন। ঈদের পর ইনকাম কম হচ্ছে। লিগ্যালি বলছি, ঈদের পর আর মাছ খাইনি। তবে মাঝেমধ্যে একটা মুরগি কিনে কয় দিন ধরে ধরে খাওয়া হয়।’

একটি চৌকিখাট বানিয়ে ১০০ টাকা মজুরি পান মানিক
ছবি: প্রথম আলো

কয়েক বছর আগেও রূপসা ট্রাফিক মোড় থেকে খুলনা কলেজিয়েট গার্লস স্কুল পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার ফুটপাতের পুরোটাই কাঠের আসবাবের দোকান ছিল। অবৈধভাবে দখল করা সেই দোকানগুলো সরিয়ে দিয়েছে সিটি করপোরেশন। সেখানে মানিকেরও একটা দোকান ছিল। নিজেরা তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গা থেকে আসবাবপত্র কিনে বিক্রি করতেন মানিক। তবে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লাখ চারেক টাকা দেনায় পড়েন তিনি।

মানিক বলেন, ‘দেনা নিয়েই সবচেয়ে বিপদে আছি। যেসব ঘর থেকে মাল নিতাম তাঁদের কাছেই দেনা তিন লাখ। তারা টাকা চায়। আবার নিজের ধার করা লাগছিল, তাতে কিছু সুদ দেওয়া লাগে। দেনাটাই এখন মহাচাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

দেনাটা শোধ করে গ্রামে ফিরে যেতে চান মানিক। তবে গ্রামে কাজ কম থাকার চিন্তাটাও ভাবাচ্ছে। মানিক বললেন, ‘শহর ছেড়েই দেব। দেনা শোধ হলে গ্রামের বাড়ি চলে যাব। বাড়িতে থাকার জায়গা আছে। শাকপাতা লাগানো যাবে। খেয়ে বাঁচা যাবে। মানসিক চাপটা থাকবে না। এই এত রাত পর্যন্ত কাজ করা লাগবে না।’

মানিকের সঙ্গেই কাজ করেন আবদুর রহমান (৪০)। বরিশালের গৌরনদী থেকে এসে রহমানের বাবা খুলনার দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন। সেই সুবাদেই ছোট থেকে খুলনায় বসবাস। কলেজ আর স্কুলপড়ুয়া দুই মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন চানমারী এলাকায়। তিনিও ২৬ বছর ধরে এই কাঠের কাজ করছেন।

আবদুর রহমানরা মূলত চৌকিখাট তৈরি করেন। তক্তা, কাঠ এগুলো মহাজন কিনে দেন। একটা চৌকিখাট পুরো বানিয়ে দিলে হাতে পান ১০০ টাকা। দিনে সর্বোচ্চ চারটা বানানো যায়। যেদিন কাজ হয় না, সেদিন রেজগারও থাকে না।

আবদুর রহমান বললেন, ‘কাজের ওপর টাকা। যেদিন হয় না, সেদিন বইসে থাকা লাগে। এখন তো কঠিন হয়ে গেছে। সবকিছুর দাম বাড়ছে, আমাগে ইনকাম পাঁচ পয়সা বাড়েনি। পাঁচ থেকে ছয় বছর ধরে কাজের রেট একই রকম আছে। আরও কমাইতে পারলে মাহাজনরা খুশি।’