‘ধর্ষণ-অপহরণের ঘটনা আদালতের বাইরে মীমাংসার সুযোগ নেই’

ধর্ষণ, অপহরণ ও অপহরণে সহায়তার ঘটনা কোনোভাবেই আদালতের বাইরে আইনগতভাবে আপস-মীমাংসার সুযোগ নেই। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আদালতে বিচারাধীন থাকা ধর্ষণের একটি মামলার বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষ আইনজীবী এবং জেলার একজন মানবাধিকারকর্মী এমন মন্তব্য করেছেন। সম্প্রতি আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে এক কিশোরীর মায়ের ‘মেয়ের ধর্ষণের মূল্য কি ৯০ হাজার টাকা?’ প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা ওই মন্তব্য করেন।

এরই মধ্যে ওই কিশোরী ধর্ষণ মামলাটির অভিযোগপত্র আদালতে জমা দিয়েছে পুলিশ। অভিযোগপত্রে ধর্ষণ নয়, ওই কিশোরীকে অপহরণ করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ২০২১ সালের ২৬ মে রাত ১০টার দিকে কসবা উপজেলায় ওই কিশোরী (১৪) ধর্ষণের শিকার হয় বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় কিশোরীর মা বাদী হয়ে তিনজনকে আসামি করে কসবা থানায় ধর্ষণ মামলা করেন। স্থানীয় প্রভাবশালীরা ৫ মার্চ ঘটনাটি ৯০ হাজার টাকায় রফা করেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা মহিলা পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক শামীমা সিকদার প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিকভাবে স্থানীয় ও ক্ষমতাসীন দলের লোকজন প্রভাব সৃষ্টি করে টাকার বিনিময়ে ধর্ষণ ও অপহরণের ঘটনায় আপস করতে বাধ্য করেন। ৯০ হাজার টাকা নয়, ৯০ কোটি টাকার বিনিময়েও কি ধর্ষিতার ক্ষতিপূরণ সম্ভব? পুলিশ, হাসপাতাল ও আদালতে সব জায়গায় মেয়েদেরই সবকিছু প্রমাণ করতে হয়। দুই বছর আগে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড করেছে সরকার। কিন্তু এর বাস্তবায়ন হয়নি। মৃত্যুদণ্ডের রায় বাস্তবায়িত হলে ধর্ষণের ঘটনা কমে আসবে।

মামলাটির এজাহার ও কিশোরীর পরিবার সূত্রে জানা যায়, কিশোরীকে সাইফুল মিয়া (২৮) নামের এক তরুণ মুঠোফোনে প্রায়ই উত্ত্যক্ত করতেন। গত বছরের ২৬ মে খালার বাড়িতে বেড়াতে যায় ওই কিশোরী। সাইফুল ফোন করে রাতে দেখা করতে বললে কিশোরী অসম্মতি জানায়। একপর্যায়ে সাইফুলের অনুরোধে রাত ১০টার দিকে বাড়ির বাইরে বের হয় ওই কিশোরী। তখন সাইফুল তাঁর দুই সহযোগীকে নিয়ে কিশোরীর মুখ চেপে ধরেন। কিশোরীকে জোর করে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় তুলে একটি বাড়িতে নিয়ে ধর্ষণ করেন। পরে গোসাইস্থল ক্যাম্পে বিজিবির সদস্যরা কিশোরীকে উদ্ধার করে স্থানীয় ইউপি সদস্য হরমুজ মিয়ার জিম্মায় দেন।

এ ঘটনায় ২৭ মে কিশোরীর মা বাদী হয়ে সাইফুলসহ তিনজনকে আসামি করে কসবা থানায় ধর্ষণ মামলা করেন। গত বছরের ২৬ আগস্ট সাইফুল ও তাঁর দুই সহযোগী খোকন ও শামীম মিয়াকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।

অভিযোগপত্র ঘেঁটে জানা গেছে, সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে কিশোরীকে অপহরণের অপরাধের সত্যতা পাওয়ায় সাইফুলের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০–এর (সংশোধনী ২০০৩) ৭ ধারা এবং অপহরণে সহায়তার অপরাধে দুই সহযোগীর বিরুদ্ধে একই আইনের ৩০ ধারায় অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। তবে ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার ধারার অপরাধের সপক্ষে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পাননি বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন। কিশোরীর মায়ের দাবি, তাঁর মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সাবেক ইউপি সদস্য মোর্শেদ মিয়া, গোপীনাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের ভাই আবদুল হান্নান, স্থানীয় বাসিন্দা কবির হোসেন, আবুল কালাম, আনোয়ার হোসেনসহ কয়েকজন ৫ মার্চ ৯০ হাজার টাকায় ধর্ষণের ঘটনাটি রফা করেন।

মোর্শেদ মিয়া ও আবদুল হান্নান প্রথম আলোকে বলেন, এখানে আইনগত বিষয় একটি ও সামাজিক বিষয় আরেকটি। ৯০ হাজার টাকার বিনিময়ে মীমাংসা হয়েছে। আদালত প্রাঙ্গণে উকিলের সামনেই টাকা দেওয়া হয়েছিল। এলাকার বিষয় হওয়ায় তাঁরা সামাজিকভাবে মীমাংসা করেছিলেন। মীমাংসা হয়েছে, এই মর্মে কিশোরীর মা আদালতে উকিলদের কাছে লিখিত দিয়েছেন।

এদিকে চলতি মাসের ৭ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল দ্বিতীয় আদালতে অভিযুক্ত সাইফুল আত্মসমর্পণ করেন। সেদিন মামলার বাদী কিশোরীর মা কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আদালতকে বলেন, ‘মেয়ের ধর্ষণের মূল্য কি ৯০ হাজার টাকা?’

কিশোরীর মা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ঘটনাটি রফা করতে আমাকে বারবার হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। ফোন করে মেয়ের মুখে অ্যাসিড মারার ও আমাকে ঘুমের মধ্যে কেটে মেরে ফেলার একাধিক হুমকি দিয়েছে। এই ভয়ে আপসে রাজি হই। ৭ মার্চ কোর্ট এলাকায় উকিল টিটুর সামনে আমাকে টাকা দিয়েছিল।

আসামির লোকজন ছয়জন উকিলকে দাঁড় করিয়েছে। তারা আমাদের মা-মেয়ের সম্পর্কে বাজে কথা বলে। আমি তখন আদালতকে বলেছি, আমাকে তারা জোরজবরদস্তি করে টাকা দিয়েছে এবং আপস করিয়েছে। ৯০ হাজার টাকার কাছে যদি মেয়েই বিক্রি করতে হয়, তাহলে সত্যের কাছেই মেয়েকে বিক্রি করব। আদালত থেকে বের হয়ে আমি টাকা ফেরত দিয়েছি। আমি ন্যায়বিচার চাই।’

আসামিপক্ষের আইনজীবী আসাদুজ্জামান টিটু প্রথম আলোকে বলেন, ধর্ষণ, অপহরণ ও অপহরণে সহায়তার ঘটনা কখনোই আদালতের বাইরে আইনগতভাবে আপস-মীমাংসার সুযোগ নেই। তিনি আরও বলেন, ‘আপসের বিষয়টি আমি জানতাম না।’

সহকারী সরকারি কৌঁসুলি ফেরদৌস মিঞা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদালতের বাইরে এই ধরনের ঘটনার আপস-রফা রাষ্ট্রপক্ষ উৎসাহিত করে না। কেউ যদি দায়িত্ব নিয়ে এ রকম করে থাকেন, সেটি ভিন্ন বিষয়। আমরা ওই নারীকে ন্যায়বিচার পেতে সহায়তা করছি।’