ধূপখোলা মাঠে বাণিজ্যিক শিশুপার্ক হচ্ছে না, তবে মার্কেট হচ্ছে!

নকশায় মার্কেটসহ ধূপখোলা মাঠ
নকশায় মার্কেটসহ ধূপখোলা মাঠ

শেষ পর্যন্ত পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ধূপখোলা মাঠে বাণিজ্যিক শিশুপার্ক নির্মাণ থেকে পিছু হটেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী, সেখানে গ্যালারিসহ খেলার মাঠ ও শিশু কর্নার হবে। সেখানে শিশুদের জন্য থাকবে বিভিন্ন রাইড।

কিন্তু নতুন পরিকল্পনায় মাঠটির পশ্চিম পাশে একটি বহুতল মার্কেট নির্মাণ করার কথা বলছে করপোরেশন। শিশুদের খেলার জায়গা ঘেঁষে মার্কেট নির্মাণের এই পরিকল্পনাকে অবিবেচনাপ্রসূত বলে মনে করছেন এলাকার লোকজন। তাতে শিশুদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে।

ডিএসসিসি বলছে, মাঠের চারপাশে থাকা দোকানগুলো স্থানান্তর করতে এই মার্কেট করা হবে। চারপাশে দেয়ালের পরিবর্তে গ্রিলের ব্যবস্থা করা হবে।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ঘনবসতিপূর্ণ পুরান ঢাকায় বাণিজ্যিক পার্কের চেয়ে উন্মুক্ত সবুজ পরিবেশ ও খেলার মাঠ বেশি জরুরি। বর্তমানে মাঠটি যে অবস্থায় আছে, তা খেলাধুলার অনুপযোগী। এই অবস্থায়ই ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তাতে খেলার সময় অনেক শিক্ষার্থী আহতও হয়েছেন।

ধূপখোলা মাঠটি ডিএসসিসির ৪৫ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাধীন। ডিস্টিলারি রোড, দীননাথ সেন রোড, কেশব ব্যানার্জি রোড, শশীভূষণ চ্যাটার্জি লেন, রজনী চৌধুরী রোড, সাবেক শরাফতগঞ্জ লেন, সত্যেন্দ্র কুমার দাস রোড এলাকা নিয়ে এই ওয়ার্ড গঠিত। এসব এলাকার প্রায় সব কটি সড়ক খানাখন্দে ভরা, পয়োনিষ্কাশন-ব্যবস্থা প্রায় অকার্যকর। এর মধ্যে দুই বছর ধরে পানি পান না রজনী চৌধুরী রোড, দীননাথ সেন রোড, ডিস্টিলারি রোডের বাসিন্দারা।

এ ছাড়া ডিস্টিলারি রোডে অবৈধভাবে বসছে কাঁচাবাজার। এতে সড়কটিতে যান চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গতকাল বুধবার এই এলাকা ঘুরে স্থানীয় বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

ধূপখোলা মাঠ

প্রায় সাত একর আয়তনের ধূপখোলা মাঠটি তিন ভাগে ভাগ করা। এর একটি অংশ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ। বাকি দুটি অংশ ইস্ট এন্ড ক্লাব মাঠ ও স্থানীয় খেলার মাঠ। পুরো মাঠের মালিক ডিএসসিসি।

ধূপখোলা মাঠের বর্তমান চিত্র
ধূপখোলা মাঠের বর্তমান চিত্র

সংস্থাটির প্রকৌশল বিভাগ জানায়, ২০১৬ সালের মার্চে ডিএসসিসির বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার বরাদ্দ দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। এর মধ্যে ধূপখোলা মাঠে একটি বাণিজ্যিক শিশুপার্ক নির্মাণে ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যেই তারা নকশা চূড়ান্ত করে, দরপত্র আহ্বানের প্রস্তুতি চলছিল। গত বছরের ২৪ নভেম্বর ধূপখোলা মাঠে বাণিজ্যিক শিশুপার্ক তৈরির উদ্যোগ! শিরোনামে প্রথম আলোতে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। প্রতিবেদন প্রকাশের পর বাণিজ্যিক পার্ক নির্মাণের প্রতিবাদে সভা-সমাবেশ ও মানববন্ধন করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। বাধ্য হয়ে গণ–শুনানির আয়োজন করে ডিএসসিসি। তাতে মহল্লার লোকজন ধূপখোলা মাঠ রক্ষার পক্ষে অবস্থান নেন।

কয়েক মাস আগে বাণিজ্যিক শিশুপার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা থেকে সরে আসে ডিএসসিসি। নতুন পরিকল্পনায় বরাদ্দের ওই টাকা দিয়েই মাঠ সংস্কার, শিশু কর্নার ও মার্কেট নির্মাণ করা হবে বলে জানিয়েছেন ডিএসসিসির প্রকৌশল বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা।

ইস্ট এন্ড ক্লাবের মাঠে খুদে ফুটবল খেলোয়াড়দের ফ্রি প্রশিক্ষণ দেয় গেন্ডারিয়া সোনালী অতীত ফুটবল খেলোয়াড় কল্যাণ সংস্থা। এই সংস্থার সংগঠক ও কোচ মহিউদ্দিন আহমেদ। তাঁর নেতৃত্বেই বাণিজ্যিক শিশুপার্ক নয়, উন্নত সবুজ খেলার মাঠ চাই—স্লোগানে আন্দোলন করেছিলেন স্থানীয় লোকজন। মহিউদ্দিন আহমেদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই মাঠ ক্রিকেট ও ফুটবলের জাতীয় পর্যায়ের অনেক খেলোয়াড় তৈরি করেছে। তাই মাঠটির ঐতিহ্য ধরে রাখা ও নতুন প্রজন্মকে খেলাধুলামুখী রাখতেই আমরা আন্দোলন করেছিলাম। তবে প্রথম আলোর ওই প্রতিবেদনের কারণেই আমাদের আন্দোলন জোরালো হয়েছিল।’

ওয়ারীর বাসিন্দা ও মাদকবিরোধী সংগঠন প্রত্যাশার সাধারণ সম্পাদক হেলাল আহমেদ বলেন, পুরান ঢাকার সাতটি থানা এলাকার শিশু-কিশোরেরা এই মাঠে খেলাধুলা করে। তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য আরও মাঠ দরকার। সরকার বা সিটি করপোরেশনকে এই বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হবে।

খানাখন্দে ভরা সড়ক

গতকালডিস্টিলারি রোড, কেশব ব্যানার্জি রোড, শশীভূষণ চ্যাটার্জি লেন, রজনী চৌধুরী রোড, সাবেক শরাফতগঞ্জ লেন, সত্যেন্দ্র কুমার দাস রোড ঘুরে খানাখন্দ দেখা যায়। তবে এর মধ্যে যেসব রোডে বড় গর্ত আছে, সেগুলোতে ইট-সুরকি ফেলা হয়েছে।

কেশব ব্যানার্জি রোডের বাসিন্দা জাকির হোসেন বলেন, সড়কের এই খানাখন্দের কারণে বাতাসে ব্যাপক ধুলাবালি ওড়ে। বড় গর্তগুলোতে নিজ নিজ মহল্লার লোকজনই ইট-সুরকি ফেলছে। সিটি করপোরেশন কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।

পানিসংকট

দুই বছর ধরে রজনী চৌধুরী রোড, দীননাথ সেন রোড, ডিস্টিলারি রোডে পানিসংকটে ব্যাপক ভোগান্তি পোহাচ্ছে এই তিনটি সড়কের বাসিন্দারা। দীননাথ সেন রোডের বাসিন্দা আলী একরাম বলেন, সকাল-বিকেল দুই বেলা তাঁরা ওয়াসার লাইনে পানি পান। কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। অনেক সময় পানি সংগ্রহ করার আগেই পানি চলে যায়। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চান বাসিন্দারা।

ডিস্টিলারি রোডে অবৈধ কাঁচাবাজার

ধূপখোলা মাঠের উত্তর-পশ্চিম পাশে ডিস্টিলারি রোডের দুপাশে দেড় শতাধিক সবজি ও মাছ-মাংসের দোকান। এর মধ্যে সিটি করপোরেশন মার্কেটের সামনে দোকানের সংখ্যা বেশি। বাজারের ময়লা পানি ও আবর্জনা ছড়িয়ে পড়ে সড়কে। তা মাড়িয়ে চলাচল করছে পথচারীরা। কাঁচাবাজারের ময়লা-আবর্জনায় সড়কের দুপাশের নর্দমা বন্ধ হয়ে আছে।

ডিস্টিলারি রোডের বাসিন্দা মাসুদ আলম বলেন, সকালে এই সড়ক দিয়ে রিকশাও চলাচল করতে পারে না। অবিলম্বে কাঁচাবাজারটি উচ্ছেদ করা উচিত।