নদী দখল করে মাছ চাষ

আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের ২০-২৫ জন নেতা-কর্মী সমন্বিতভাবে নদী দখলে নিয়ে মাছ চাষ করছেন।

হোজির নদে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করছেন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। গত বুধবার বাগেরহাট সদর উপজেলার খেগড়াঘাট এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

বাগেরহাটে প্রবহমান হোজির নদীতে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে মাছ চাষের অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে। সদর উপজেলার হোজির নদীর দৈর্ঘ্য সাড়ে আট কিলোমিটার। উপজেলার ডেমা ইউনিয়ন অংশের ছয় কিলোমিটার আটকে মাছ চাষ করছেন তাঁরা।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সাল থেকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের ২০-২৫ জন নেতা-কর্মী সমন্বিতভাবে নদী দখলে নিয়ে মাছ চাষ শুরু করেন। এতে আশপাশের এলাকার কৃষিকাজ ও মাছ চাষের ক্ষতি হচ্ছে। বাঁধের কারণে বর্ষা মৌসুমে কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বাগেরহাট-রামপাল সড়কের সদর উপজেলার খেগড়াঘাট এলাকার হোজির নদীর ওপর নির্মিত সেতুর নিচ দিয়ে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। অবৈধ বাঁধের কারণে খালটিতে জোয়ার-ভাটায় স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। সেতুর নিচে আটকে দেওয়া বাঁধের ওপর খুপরি ঘরও বানিয়েছেন মাছচাষিরা। সেখানে মাছের খাবারসহ বিভিন্ন মালামাল রাখা রয়েছে। এ ছাড়া কয়েকটি জায়গায় নেট দিয়েও আটকে দেওয়া রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৭ সালের ১০ মে তৎকালীন সদর উপজেলা প্রশাসন অভিযান চালিয়ে ওই সেতুর নিচের বড় বাঁধটি অপসারণ করেছিলেন। তবে মাস না যেতেই সেখানে আবার বাঁধ দেয় তারা।

গত বুধবার বাঁধের ছবি তোলার সময় মাছের ঘের রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা এগিয়ে আসেন। এ সময় তাঁরা ছবি তোলার কারণ জানতে চান। সংবাদকর্মী পরিচয় পেয়ে তারা নাম প্রকাশ করতে চাননি। তবে তাঁরা বলেন, সেতুর নিচের বাঁধ দিয়ে নদীকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সেতুর দুই পাশেই মাছ চাষ করা হয়।

দীর্ঘ বছর ধরে এভাবে চলছে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে, তাদের লোকজন মাছ চাষ করে। এখানে সাধারণ মানুষের বলার কিছু নেই।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডেমা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি রবিউল ইসলাম, সহসভাপতি ফরহাদ শেখ, ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য ও ডেমা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ফরিদ মোল্লা, ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নকিব হাই, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য সাইফুল ফকিরের নেতৃত্বে নদীতে মাছ চাষ করা হয়। ২০-২৫ জন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী এখানে মাছ চাষের সঙ্গে জড়িত।

খাল দখলের অভিযোগ সম্পর্কে রবিউল ইসলাম বলেন, ‘প্রায় ৫০ বছর ধরে এখানে মাছ চাষ করা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আমরা ঘের করা শুরু করি। আমার সঙ্গে ২০-২৫ জন রয়েছেন। এ মৌসুমে আমরা প্রায় সাত লাখ টাকার গলদা, বাগদা, রুই, কাতলাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ছেড়েছি।’

রবিউল ইসলাম আরও বলেন, ‘কেউ কখনো আমাদের খাল দখল করে ঘের করতে নিষেধ করেনি। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে মাইকিং করার বিষয়টি আমি জানি না।’

নদী দখলের বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, জানতে চাইলে ডেমা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনি মল্লিক বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। যদি কেউ ঘের দখল করে থাকে, সেটা তাদের দায়িত্ব। তবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে সরকারি খাল মুক্ত করার জন্য আমরা মাইকিং করেছিলাম। কিছু কাজও হয়েছে।’

পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাগেরহাট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুম বিল্লাহ বলেন, গত বছর একটি প্রকল্পের আওতায় ডেমা ইউনিয়নের হোজির নদীটি খনন করা হয়েছিল। নদী ও খাল খননের সময় পাউবোর তদারকি থাকে, তাঁরা দেখভাল করেন। খনন শেষে এই খাল ও নদীর দায়দায়িত্ব জেলা ও প্রশাসনের বলে দাবি করেন এই কর্মকর্তা।

বাগেরহাট সদরের ইউএনও মুহাম্মদ মুছাব্বেরুল ইসলাম বলেন, সরকারি খাল ও নদী দখল করে মাছ চাষ বা অন্য কিছু করার সুযোগ নেই। যদি কেউ করেন, তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে নদীর বাঁধ অপসারণেরও আশ্বাস দেন তিনি।