নদের টুঁটি চেপে ধরেছে ৫১টি সেতু-কালভার্ট

ভৈরব নদের দুই পাশে মাটি ভরাট করে তার ওপর করা হয়েছে সেতু। এতে নদ হয়ে গেছে সংকুচিত। সম্প্রতি যশোর শহরের প্রাণকেন্দ্র দড়াটানা মোড়ে।ছবি: প্রথম আলো

যশোর শহরের বাবলাতলা এলাকায় ভৈরব নদের ওপর পৌনে পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘অপরিকল্পিত’ একটি সেতু নির্মাণ করা হয়। পানির উপরিভাগ থেকে সেতুটির উচ্চতা ১০ ফুটের কম। ২২০ ফুট চওড়া নদের দুই তীর সংকুচিত করে ১০০ ফুট দৈর্ঘ্যের সেতুটি নির্মাণ করে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ। পাঁচ বছর পর সেতুটি অপসারণের জন্য বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সুপারিশ করে চিঠি দিয়েছে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে।

অথচ নির্মাণের সময় ২০১৪ সালের ১৪ এপ্রিল ‘অপরিকল্পিত সেতু, ব্যয় পাঁচ কোটি’ শিরোনামে প্রথম আলোতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর ওই বছরের ২৫ মে ‘ভৈরব নদে অপরিকল্পিত সেতুর কাজ চলছেই’ শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্তাব্যক্তিদের টনক নড়েনি। ফলে অপচয় হয়েছে জনগণের প্রায় পাঁচ কোটি টাকা।

শুধু বাবলাতলা এলাকার ওই সেতু নয়, যশোর শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া ভৈরব নদের ওপর বিভিন্ন সময় সাড়ে ছয় কোটি টাকা ব্যয়ে আরও তিনটি ‘অপরিকল্পিত’ সেতু নির্মাণ করেছে সওজ। এমন আরও ৪৭টি অপরিকল্পিত সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ করেছে সরকারের ছয়টি দপ্তর। সেতুগুলো ভৈরব নদের ‘গলার কাঁটা’ হয়ে বিঁধছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিশ্রুত ২৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে ভৈরব রিভার বেসিন এলাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। ২০২২ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে বলা হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রকল্পের ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে বলে দাবি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের। কিন্তু অপরিকল্পিত সেতুগুলো অপসারণ না করলে ভৈরব নদ খননের সফলতা আসবে না বলে পাউবোর পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে সেতুসংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে জানানো হয়েছে।

ওই চিঠিতে বলা আছে, ভৈরব নদের ওপর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের (এলজিইড) ২৩টি, ত্রাণ ও পুনর্বাসন অধিদপ্তরের ১৯টি, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) তিনটি, সড়ক ও জনপথের (সওজ) চারটি, বাংলাদেশ রেলওয়ে ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের একটি করে সেতু-কালভার্ট রয়েছে। ভৈরব নদের খননকাজ সম্পন্ন করলেও নাতিদীর্ঘ এসব সেতুর কারণে কাঙ্ক্ষিত সুফল অর্জন ব্যাহত হবে। এই অবস্থায় সেতুগুলো খননকৃত ভৈরব নদের প্রশস্ততা অনুযায়ী পুনর্নির্মাণের অনুরোধ করা হলো।

জানতে চাইলে পাউবো যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ভৈরব নদের ওপর নির্মিত নাতিদীর্ঘ ৫১টি সেতু ও কালভার্ট অপসারণ করে নদীর প্রশস্ততা অনুযায়ী পুনর্নির্মাণের জন্য পানিসম্পদ অধিদপ্তরে প্রস্তাব পাঠানো হয়। অধিদপ্তরের পরামর্শক কমিটির মত অনুযায়ী, এলজিইডি ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে। রূপদিয়া এলাকার একটি সেতু প্রশস্তকরণের কাজ চলছে।

সম্প্রতি সরেজমিন দেখা গেছে, যশোর শহরের পালবাড়ি-মনিহার সড়কের বাবলাতলা এলাকায় নদের দুই পাড় মাটি দিয়ে ভরাট করে ৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা ব্যয়ে ১০০ ফুট দৈর্ঘ্যের সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে। নদীর পানির স্তর থেকে ওই সেতুর উচ্চতা ১০ ফুটের কম। এই উচ্চতার সেতু নৌযান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। বাবলাতলা থেকে নীলগঞ্জ পর্যন্ত ভৈরব নদের চার কিলোমিটারের মধ্যে নির্মিত হয়েছে এমন ছোট ছোট ছয়টি সেতু। সেতুগুলোর দৈর্ঘ্য ৫০ থেকে ১০০ ফুটের মধ্যে। অথচ নদের প্রশস্ততা ১৫০ থেকে ২৫০ ফুট। নদের দুই পাড় মাটি দিয়ে ভরাট করে সেতু নির্মাণের ফলে নদের স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সেতুগুলো যেন ভৈরব নদের টুঁটি চেপে ধরেছে।

নদের ওপর নাতিদীর্ঘ সেতু–কালভার্ট নির্মাণের বিষয়ে জানতে চাইলে এলজিইডি যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী এ কে এম আনিসুজ্জামান বলেন, ভৈরব নদের ওপর কালভার্টগুলো সত্তর থেকে আশির দশকে নির্মিত হয়েছে। এ ছাড়া সেতুগুলো ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে নির্মাণ করা হয়।

এ বিষয়ে সওজ যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, পাউবোর সুপারিশ অনুযায়ী, ভৈরব নদের ওপর নির্মিত সেতুগুলো দীর্ঘ করার কাজ শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে যশোর শহরের প্রাণকেন্দ্র দড়াটানা মোড়ের সেতুটি অপসারণ করে নতুন সেতু নির্মাণের জন্য মাটি পরীক্ষার কাজ শেষ হয়েছে। অন্য সেতুগুলো পুনর্নির্মাণের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।

পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, ভৈরব নদ খনন প্রকল্পের কাজ ইতিমধ্যে ৭০ শতাংশ শেষ হয়েছে। আগামী জুনের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে।