নরসিংদীর ১৫ জন নিখোঁজের ঘটনায় মানব পাচারকারী চক্রের ২ সদস্য গ্রেপ্তার

গ্রেপ্তার রায়পুরার হাসনাবাদ গ্রামের মামুন মোল্লা (৩৯) ও আগানগর গ্রামের সুবল চন্দ্র শীল (৪৫)
ছবি: প্রথম আলো

লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে স্পিডবোটডুবিতে নরসিংদীর ১৫ জন নিখোঁজের ঘটনায় মানব পাচারকারী চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আজ মঙ্গলবার দুপুরে নরসিংদীর পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম প্রথম আলোর কাছে তাঁদের গ্রেপ্তারের সত্যতা নিশ্চিত করেন।

গ্রেপ্তার দুজন হলেন রায়পুরা উপজেলার হাসনাবাদ গ্রামের বাচ্চু মোল্লার ছেলে মামুন মোল্লা (৩৯) এবং আগানগর গ্রামের কালীপদ শীলের ছেলে সুবল চন্দ্র শীল (৪৫)। পুলিশ বলছে, গ্রেপ্তার দুজন স্থানীয় দালাল তারেক মোল্লার সহযোগী। গতকাল সোমবার দিবাগত রাতে ওই এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করে জেলা গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) ও রায়পুরা থানা-পুলিশ।

চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি লিবিয়া থেকে অভিবাসনপ্রত্যাশী ৩৫ জন বাংলাদেশি একটি স্পিডবোটে ইতালি যাচ্ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন মালটা সীমানার জলরাশিতে ছিটকে পড়লে তাঁকে উদ্ধার করতে গিয়ে স্পিডবোটটি উল্টে সব যাত্রী ডুবে যান। সাগরে ঢেউয়ের তোড়ে একেক করে ভেসে যাচ্ছিলেন তাঁরা। ১১ ঘণ্টা পর কোস্টগার্ডের সদস্যরা উল্টে যাওয়া স্পিডবোটের ওপরে অবস্থান করা জীবিত সাতজনকে উদ্ধার করে। তবে তীরে পৌঁছানোর আগেই ঠান্ডায় জমে তাঁদের একজনের মৃত্যু হয়। এখনো নিখোঁজ ওই ২৮ জনের মধ্যে ১৫ জনই নরসিংদীর। এত দিনেও তাঁদের কোনো সন্ধান না পাওয়ায় ধারণা করা হচ্ছে, তাঁরা সবাই মারা গেছেন।

বেঁচে ফেরা ছয়জনের মধ্যে ইউসুফ মৃধা ও শেখ সামিউল নামের দুজন গত বৃহস্পতিবার দেশে ফেরার পর তাঁদের কাছেই ‘ওই দিন ঠিক কী ঘটেছিল’ তার বিস্তারিত জানতে পারেন নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনেরা। এ নিয়ে গত শনিবার রাতে প্রথম আলো অনলাইনে ‘ভূমধ্যসাগরে স্পিডবোটডুবি: দেশে ফিরে ভয়ংকর অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিলেন বেঁচে যাওয়া দুজন’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

ভূমধ্যসাগরে স্পিডবোটডুবির ঘটনায় বেঁচে ফেরা শেখ সামিউল ও ইউসুফ মৃধা
ছবি: সংগৃহীত

নিখোঁজ নরসিংদীর ১৫ জন হলেন রায়পুরার ডৌকারচরের নাদিম সরকার (২২), আলমগীর সরকার (৩৫), আল-আমিন ফরাজী (৩৩); দক্ষিণ মির্জানগরের এস এম নাহিদ (২৫); আমিরগঞ্জের ইমরান মিয়া (২১), আশিস সূত্রধর (২১), সবুজ মিয়া (২৫), হাইরমারার শাওন মিয়া (২২), সেলিম মিয়া (২৪); বেলাব উপজেলার আল আমিন (২৮); নারায়ণপুরের মতিউর রহমান (৩৭); সল্লাবাদের শরীফুল ইসলাম (২৪), সালাউদ্দিন (৩২), মো. হালিম (২৬), বিপ্লব মিয়া (২৪)। বাকি ১৩ জন ফরিদপুর, কিশোরগঞ্জ, বরিশাল, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, গাজীপুর ও সিলেট জেলার বাসিন্দা।

পুলিশ বলছে, রায়পুরার হাসনাবাদের মনির চন্দ্র শীল নামের এক ব্যক্তি পাঁচ বছর ধরে লিবিয়ায় অবস্থান করে বাংলাদেশ থেকে মানব পাচার করছেন। তাঁর মাধ্যমে রায়পুরা থেকে স্থানীয় লোকজনকে প্রলোভিত করে মানব পাচার করেন তারেক মোল্লা নামের এক ব্যক্তি। তারেক মোল্লাকে সহযোগিতা করেন মামুন মোল্লা ও সুবল চন্দ্র শীল। তাঁরা স্থানীয় তরুণ-যুবকদের বৈধ পথে ইতালি নিয়ে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে মৌখিক চুক্তিতে টাকা নেন। তাঁদের মাধ্যমেই রায়পুরার ডৌকারচর এলাকার নিখোঁজ আশিষ সূত্রধর, আলামিন ফরাজী ও নাদিম সরকার নামের তিনজন সাড়ে আট লাখ টাকা করে চুক্তি করেছিলেন। সাড়ে ছয় লাখ টাকা ওই দালালদের হাতে দেওয়ার পর তাঁরা যাত্রা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে তাঁদের ইতালি না পাঠিয়ে দালাল চক্র লিবিয়াতে পাঠায়। সেখান থেকেই অবৈধ পথে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি পাঠান তাঁরা। নিখোঁজ ওই তিনজনের পরিবারের সদস্যরা রায়পুরা থানায় মামলা করলে মামুন মোল্লা ও সুবল চন্দ্র শীলকে গ্রেপ্তার করা হয়।

আরও পড়ুন

নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা জানান, দালাল তারেক মোল্লার মাধ্যমেই সাড়ে আট লাখ টাকা চুক্তিতে রায়পুরা ও বেলাব উপজেলার অন্তত ২৫ জন তরুণ-যুবক ইতালির উদ্দেশে রওনা হন। তারেক মোল্লার দুই সহযোগী মামুন মোল্লা ও সুবল চন্দ্র শীল। তাঁদের হাতে সাড়ে ছয় লাখ টাকা করে দেওয়ার পর প্রথমে তাঁদের দুবাই নিয়ে এক সপ্তাহ রাখা হয়। পরে মিসর হয়ে তাঁদের পাঠানো হয় লিবিয়ার বেনগাজি শহরে। সেখানে আরও প্রায় দশ দিন থাকার পর ব্যক্তিগত গাড়ির ডেকের ভেতরে ভরে দুই দিনের ভ্রমণ শেষে তাঁদের নেওয়া হয় ত্রিপোলি শহরে। সেখানে একত্র হওয়া ৪২ জন বাংলাদেশিকে গত ২৭ জানুয়ারি রাতে একটি স্থানীয় সৈকতে জড়ো করেন চক্রের মূল দালাল মনির চন্দ্র শীল। পরে ২৫ জনের ধারণক্ষমতাসম্পন্ন একটি স্পিডবোটে ৪২ জনকে ওঠানো হয়। স্পিডবোটের দুই মিসরীয় চালক তাঁদের মধ্যে পাঁচজনকে নামিয়ে দিয়ে ৩৭ জনকে নিয়ে যাত্রা শুরু করেন।

তাঁরা বলেন, লিবিয়া থেকে রওনা হয়ে তিউনিসিয়া পার হয়ে মাল্টা জলসীমা অতিক্রম করার সময় তাঁদের একজন চলন্ত স্পিডবোট থেকে সাগরে পড়ে যান। পরে স্পিডবোট ঘুরিয়ে তাঁকে টেনে তোলার সময় একদিকে কাত হয়ে ঢেউয়ের তোড়ে স্পিডবোট উল্টে সব যাত্রী সাগরে ডুবে যান। তাঁদের মধ্যে সাতজন উল্টে যাওয়া স্পিডবোটের ওপরে উঠে বসতে পেরেছিলেন। বাকিরা একেক করে কেউ ডুবে যাচ্ছিলেন, কেউ ভেসে যাচ্ছিলেন। ১১ ঘণ্টা এভাবে থাকার পর দূরে একটি কোস্টগার্ডের জাহাজ যেতে দেখে তাঁদের একজন পরা লাল জামা খুলে উড়াতে থাকেন। ওই সাতজনকে জীবিত উদ্ধার করা হলেও তীরে নেওয়ার পথেই একজনের মৃত্যু হয়। ছয়জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে প্রায় এক মাস জেলে রাখার পর স্থানীয় দূতাবাসের সহযোগিতায় দুজন দেশে ফেরেন। ওই দুজনের কাছেই জানা যায়, স্পিডবোটটির মিসরীয় দুই চালক ও ২৮ জন বাংলাদেশি সাগরে ভেসে গেছেন।

আরও পড়ুন

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাড়ে আট লাখ টাকায় বৈধভাবে প্লেনে করে ইতালি নিয়ে যাওয়ার চুক্তি দালালদের সঙ্গে হলেও অবৈধভাবে সেখানে যাওয়ার বিষয়টি জানা যায়, নিখোঁজ ব্যক্তিদের লিবিয়ায় অবস্থানের সময়। অবৈধ পথে ইতালি যাত্রায় নরসিংদী থেকেই ছিলেন অন্তত ২৪ জন। এখনো নিখোঁজ আছেন ১৫ জন, ১ জন বেঁচে ফিরেছেন, ২ জন ফেরার অপেক্ষায়। ১ জন মারা গেছেন এবং ৫ জন এখনো লিবিয়ায় অবস্থান করছেন।

পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম প্রথম আলোকে বলেন, লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে নিখোঁজ আশীষ সূত্রধরের বাবা অনিল চন্দ্র সূত্রধরের করা মামলায় দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরা দুজন আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী চক্রের সক্রিয় সদস্য বলে জানা গেছে। আজ বিকেলে তাঁদের আদালতে তুলে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করা হলে আদালত মামুন মোল্লাকে এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। স্থানীয় মূল দালাল তারেক মোল্লাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।