চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন
নাগরিক সেবার কাজে নজর নেই
নাগরিক সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে খাল ও নালায় পড়ে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা।
নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে সিটি করপোরেশনের প্রধান কাজ হিসেবে ধরা হয় তিনটি—রাস্তাঘাটের উন্নয়ন ও সংস্কার, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও মশকনিধন এবং সড়ক আলোকায়ন। ১০ বছর ধরে নাগরিক সেবার এ কাজগুলোতে নজর নেই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের। রুটিন কাজেই দায় সারছে কর্তৃপক্ষ।
গুরুত্বের দিক দিয়ে ঢাকার পরেই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অবস্থান। চট্টগ্রাম বন্দরের কারণে অর্থনৈতিকভাবে এ নগরের গুরুত্ব অনেক বেশি। করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, ১৬০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ নগরে বসবাস করে প্রায় ৬০ লাখ লোক। ওয়ার্ড আছে ৪১টি।
বন্দরনগর চট্টগ্রামের দীর্ঘদিনের পুরোনো সমস্যা জলাবদ্ধতা। এ সমস্যা নিরসনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের একটি, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) দুটি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার এসব প্রকল্পের কাজের অগ্রগতিও কম। ফলে প্রতি বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির সময় নগরের অধিকাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। সামনের বর্ষা মৌসুমেও এ ভোগান্তি থেকে মুক্তির সম্ভাবনা কম।
এসব সমস্যার সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে খাল-নালায় পড়ে মানুষের মৃত্যু। উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের কারণে বিপজ্জনক হয়ে পড়া উন্মুক্ত নালা-নর্দমা ও খালে পড়ে গত ছয় মাসের ব্যবধানে মারা গেছেন পাঁচজন। এর মধ্যে একজনকে এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী সম্প্রতি নগরের বহদ্দারহাটে নিজের বাড়িতে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি অগোছালো অবস্থায় দায়িত্ব নিয়েছেন। সিটি করপোরেশনের কাজের শৃঙ্খলা আনতে সময় লাগবে। নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার কাজে শতভাগ না হলেও অন্তত ৮০ ভাগ সফল। বেহাল থাকা সড়কগুলো ঠিক করা হচ্ছে। বর্জ্য অপসারণের কাজেও গতি আনা হচ্ছে। আর মশকনিধনে কার্যকর ওষুধ কেনা হয়েছে।
বেহাল রাস্তায় দুর্ভোগ
চট্টগ্রাম নগরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোর একটি অক্সিজেন-মুরাদপুর সড়ক। কিন্তু পানির পাইপ স্থাপনের জন্য সড়কটি খুঁড়ে ফেলে রাখা হয়েছে। প্রতি বর্ষা মৌসুমে সড়কটি বেহাল হয়ে পড়ে। বিভিন্ন স্থানে সৃষ্টি হয় খানাখন্দ। নগরের আরেকটি ব্যস্ততম সড়ক মেরিনার্স রোড। নগরের কর্ণফুলী নদীর তীরে এ সড়কে রয়েছে ছোট-বড় গর্ত। ধুলার যন্ত্রণা তো আছেই। নগরের পোর্ট কানেকটিং রোডের দুর্ভোগ এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি।
এ ছাড়া পাথরঘাটার আশরাফ আলী সড়ক, হালিশহরের চৌচালা সড়ক, অক্সিজেন থেকে কুয়াইশ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, বহদ্দারহাটের হাজী চান মিয়া সড়ক, শুলকবহরের আবদুল হামিদ সড়ক, আগ্রাবাদের মোগলটুলী সড়ক, চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার অভ্যন্তরীণ সড়কও বেহাল অবস্থায় দেখা গেছে।
বাতি জ্বলে না সড়কে
সড়কের আলোকায়ন নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন খোদ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলররাই। নগরের সরাইপাড়া ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. নুরুল আমিন ও পাহাড়তলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরী সম্প্রতি সিটি করপোরেশনের সাধারণ সভায় অভিযোগ করেন, সড়ক আলোকায়নের জন্য বাতি লাগানো হলেও তা অধিকাংশ সময় জ্বলে না। বৈদ্যুতিক বাতিগুলো দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আবার বৈদ্যুতিক তারও চুরি হচ্ছে নিয়মিত। একই অভিযোগ করেছেন পশ্চিম মাদারবাড়ি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর গোলাম মো. জোবায়ের।
তবে প্রকৌশল বিভাগ থেকে দাবি করা হয়, নগরের ৮০ ভাগ এলাকা আলোকায়ন করা হয়েছে। কিন্তু সরেজমিনে ঘুরে ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে উল্টো চিত্র পাওয়া যায়।
চট্টগ্রাম নগরের পাহাড়তলীর মুরগি ফার্ম এলাকা, সরাইপাড়ার বাচা মিয়া সড়ক ও ইব্রাহিম সড়ক, ফকিরপাড়া এলাকা, সার্সন রোড, শুলকবহরের শেখ বাহারউল্লাহ সড়ক, বন গবেষণাগার সড়ক, নয়া সড়ক, গরিবউল্লাহ শাহ মাজারের সামনের সড়ক, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ (অক্সিজেন-কুয়াইশ সংযোগ সড়ক), টেকনিক্যাল সড়ক এলাকায় প্রায় সময় সড়কবাতি জ্বলে না বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা। মাঝেমধ্যে চট্টগ্রামের উড়ালসড়কেও সড়কবাতি জ্বলে না।
নালা-খালে ময়লা, বাসায় মশার যন্ত্রণা
চট্টগ্রাম নগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজে শৃঙ্খলা ফেরাতে সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন চালু করেছিলেন ডোর টু ডোর (বাসাবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে সরাসরি বর্জ্য সংগ্রহ) পদ্ধতি। ২০১৬ সালে এ প্রকল্প চালুর সময় বলা হয়েছিল, এ কার্যক্রমের ফলে নগরের যেখানে-সেখানে ময়লা পড়ে থাকবে না।
কিন্তু সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। দিনের বেশির ভাগ সময় উন্মুক্ত অবস্থায় পড়ে থাকছে গত ২৭ সেপ্টেম্বর নগরের আগ্রাবাদে ফুটপাত থেকে নালায় পড়ে তলিয়ে মারা যান বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রী শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়া (১৯)। নালায় ময়লার স্তূপের কারণে উদ্ধার কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়। একই ঘটনা ঘটে শিশু মো. কামাল উদ্দিনের (১২) ক্ষেত্রেও।
এদিকে মশকনিধনে কী ওষুধ ব্যবহার করা হবে, তা নিয়ে এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যস্ত আছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। আগের মেয়রের আমলে ওষুধ অকার্যকর বলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে।
নগরের চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার বাসিন্দা স্বপন ইসলাম বলেন, মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে গেছেন। সিটি করপোরেশনের লোকজন মাঝেমধ্যে নামকাওয়াস্তে ওষুধ ছিটিয়ে যান। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি।
সিটি করপোরেশনের উপপ্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা মোরশেদুল আলম দাবি করেছেন, তাঁরা কার্যকর ওষুধ কেনার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। ইতিমধ্যে কিছু ওষুধ কেনা হয়েছে।
সিটি করপোরেশনের কার্যক্রমের বিষয়ে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সাধারণ সম্পাদক নগর পরিকল্পনাবিদ জেরিনা হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নগরবাসীর তো বেশি চাহিদা নেই—বাসস্থান, শিক্ষা ও নিরাপদে চলাফেরার নিশ্চয়তা আর সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। কিন্তু এসব সুবিধা তো পরিপূর্ণভাবে পাচ্ছেন না তাঁরা। তা ছাড়া সড়কে বাতি জ্বলে না ঠিকমতো, ফুটপাতে হাঁটার সুযোগ নেই। আর নগরবাসীর সুষ্ঠুভাবে বসবাসের জন্য উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের যে সমন্বয় থাকার কথা, সেটিও নেই। ফলে উন্নয়নকাজ নিয়ে দুর্ভোগে ভুগতে হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে।