নাব্যতা–সংকট, অবৈধভাবে চলছে বালু উত্তোলন

ঘাঘট নদের বিভিন্ন এলাকায় চলছে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন। খনন না করায় শীতকালে পলি জমে নদ আর সমতল যেন এক হয়ে যায়।

রংপুরে ঘাঘট নদ বেহাল। বছরের পর বছর ধরে ঘাঘট নদ খনন করা হয়নি। নাব্যতা হারিয়ে পলি জমে চর জেগেছে নদের মাঝখানে। সেখানে শুষ্ক মৌসুমে চলে চাষাবাদও। গত শনিবার নগরের নিসবেতগঞ্জে
ছবি: প্রথম আলো

রংপুর নগরের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে ঘাঘট নদ। নদ থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন চলছে। ফলে বিভিন্ন জায়গায় নদের পাড় ভেঙে বিলীন হচ্ছে আবাদি জমি ও বসতভিটা। অন্যদিকে পানিপ্রবাহ কম থাকায় নদের বিভিন্ন স্থানে জেগে উঠেছে চর। সেখানে চলছে ফসলের চাষ।

রংপুর সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, তিস্তা নদীর উৎসমুখ হয়ে নীলফামারী জেলার জলঢাকা উপজেলা থেকে ঘাঘট নদের উৎপত্তি। নদটি রংপুর নগরে প্রবেশ করেছে উত্তম হাজিরহাট এলাকা দিয়ে। সেখান থেকে নগরের ভেতর দিয়ে দমদমা সেতু পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে মিঠাপুকুর উপজেলার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। রংপুরের ওপর দিয়ে এ নদের ৪৫-৫০ কিলোমিটার অংশ প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র।

সরেজমিনে দেখা যায়, নগরের উত্তম হাজিরহাট, নিসবেতগঞ্জ, দমদমা, কুটিপাড়া, গুচ্ছগ্রাম, নাজিরদিঘর, শিংগিমারী ও রংপুর সদর উপজেলার ধর্মদাস, লক্ষ্মণপাড়া, ইসলামপুরসহ আরও কিছু এলাকায় নদ থেকে বালু তোলা হচ্ছে। স্থানীয় লোকজন বলেন, একশ্রেণির বালু ব্যবসায়ী শ্যালো মেশিন দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছেন। এ নিয়ে জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিক পত্রিকায় একাধিকবার লেখালেখি হওয়ার পর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে অভিযান চালানো হয়। মালামাল জব্দ করা হয়। কিছুদিন বন্ধ থাকার পর আবার বালু উত্তোলন শুরু হয়। এখন দিনের বেলায় বালু তোলা বন্ধ হলেও মাঝেমধ্যে মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত বালু তোলা হচ্ছে।

নিসবেতগঞ্জ এলাকায় গুচ্ছগ্রামের পাশে ঘাঘট নদের প্রস্থ অনেক বড়। একই চিত্র দেখা যায় দমদমা এলাকাতেও। স্থানীয় ব্যক্তিরা বলেন, শ্যালো মেশিন দিয়ে এখানে বালু তোলা হচ্ছে। প্রতিনিয়ত বালু তুলতে তুলতে দুই পারের আবাদি জমি ভেঙে যায়। ফলে এ এলাকায় নদ প্রশস্ত হয়েছে।

এদিকে নিসবেতগঞ্জ এলাকার আরেক অংশে দেখা যায়, পলি পড়ে নদের তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। জেগে ওঠা চরে ধান চাষও চলে। আশপাশের লোকজন বলেন, বছরের পর বছর ধরে ঘাঘট নদ খনন করা হয়নি। একপর্যায়ে নদের তলদেশ ও আশপাশের আবাদি জমির স্তর সমান হয়ে পড়ে। তখন এ চরে চাষাবাদ করা হয়। আবার বর্ষার সময় তিস্তা নদীর পানি ঘাঘট নদে ঢুকে পড়ে। তখন আবার এ বালু চর স্রোতের ধাক্কায় ভেঙে যায়।

নিসবেতগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বালু ব্যবসায়িক কত আর ঠ্যাকে থুইবেন। এলাকার জনগণের কারও কথা ওনাদের কানে যায় না। সিটি করপোরেশন আসি তুলি দেয়। কয়েক দিন বন্ধ থাকার পর ফির তোলা শুরু হয়।’

নগরের কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, গত ফেব্রুয়ারি মাসে রংপুর নগরের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে নাজিরদিগর এলাকায় ঘাঘট নদ থেকে অবৈধভাবে বালু তোলা বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেন এলাকাবাসী। সেই সঙ্গে সিটি মেয়র ও জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপিও দেওয়া হয়। একইভাবে ঘাঘট নদের পারের বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় জনগণ নদের পাড়ের মাটি কাটা ও বালু উত্তোলন বন্ধের দাবিতে বহুবার মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছেন। একই সঙ্গে রিভারাইন পিপল নামের একটি সংগঠন গত আট বছর থেকে নদীকৃত্য দিবসে নদপাড়ে গিয়ে নদ রক্ষার জন্য মানববন্ধন সমাবেশ করছে।

রিভারাইন পিপল সংগঠনের পরিচালক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নদী গবেষক তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘আমরা শুধু বছরের একটি দিনই নয়, প্রায়ই নদীপারের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে নদী রক্ষার জন্য নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করে আসছি।’ তিনি আরও বলেন, ঘাঘট নদের তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নদীশাসন না হওয়ার কারণে বর্ষার সময় খুব সহজে বাসাবাড়িতে পানি উঠে যায়। আবার শীতকালে নদ আর সমতল এক হয়ে যায়।

সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান বলেন, বালু উত্তোলনের খবর পাওয়ার পর এলাকায় অভিযান চালিয়ে অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের মালামাল জব্দ করা হয়। নদ রক্ষায় তাঁরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছেন।