নারী কর্মকর্তাকে ‘থাপ্পড় দিয়ে পাবনাছাড়া’ করার হুমকি সাংসদ নাদিরার

নারী দিবসের আলোচনা সভায় সাংসদের হুমকির বিষয় তুলে ধরে বক্তব্য দেন মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা কানিজ আইরিন জাহান। আজ মঙ্গলবার পাবনা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে
ছবি: প্রথম আলো

সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ নাদিরা ইয়াসমিন ‘থাপ্পড় দিয়ে’ পাবনা জেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তাকে ‘পাবনাছাড়া’ করার হুমকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আজ মঙ্গলবার সকালে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা কানিজ আইরিন জাহান এ অভিযোগ করেন।

পাবনা জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে আয়োজিত এ সভায় প্রধান অতিথি থাকার কথা ছিল সাংসদ নাদিরা ইয়াসমিনের। অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ জানাতে ‘দেরি হওয়ার কারণে’ সাংসদ এই হুমকি দেন বলে অভিযোগ ওই কর্মকর্তার। তিনি মুঠোফোনে কথোপকথনের সময় দেওয়া এই হুমকির অডিও রেকর্ড থাকার কথাও অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন। এই অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও ছড়িয়ে পড়েছে।

সভার ব্যানারে প্রধান অতিথি হিসেবে নাম থাকলেও সাংসদ নাদিরা ইয়াসমিন উপস্থিত ছিলেন না। অভিযোগের বিষয়ে মঙ্গলবার দুপুরে তিনি পাবনা প্রেসক্লাব মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া অডিওর কণ্ঠ ও ফোন নম্বর তাঁর নয় বলে তিনি দাবি করেছেন।

অডিও রেকর্ডে শোনা যায়, প্রথমে কেউ একজন ফোন দিয়ে মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলছেন। নারী দিবসের অনুষ্ঠানে সাংসদকে কেন আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, তা জানতে চাচ্ছেন। মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে বলছেন।

দুজনের এই কথোপকথনের মধ্যেই হঠাৎ অন্য একটি কণ্ঠ ক্ষিপ্তস্বরে বলছেন, ‘আপনি কী হয়েছেন? আপনি নারী হয়ে নারীদের সম্মান করেন না। আপনাকে এক থাপ্পড় মেরে পাবনাছাড়া করব কিন্তু, বেশি স্পর্ধা হয়েছে, সবকিছু কি আপনাকে লিজ দেওয়া হয়েছে? মেয়েদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন, আপনাকে কি করে পাবনাছাড়া করতে হয়, তার ব্যবস্থা আমি করছি।’

অডিও রেকর্ডে মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তাকে উদ্দেশ করে আরও বলতে শোনা যায়, ‘আপনি কর্মকর্তা, আপনাকে এমপির বাসায় আসতে হবে, এসে দাওয়াত করতে হবে। আর কালকের প্রোগ্রামে যদি আমি দাওয়াত না পাই আপনাকে কীভাবে পাবনাছাড়া করতে হয়, তার ব্যবস্থা আমি করব। আপনাকে ছাড়া করতে ১০ মিনিটের ব্যাপার।’

কানিজ আইরিন জাহান বলেন, প্রথম কণ্ঠটি উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান শামসুন্নাহারের। আর পরে ক্ষিপ্তস্বরে কথা বলা (থাপ্পড় মেরে পাবনাছাড়া করার) কণ্ঠটি সাংসদ নাদিরা ইয়াসমিনের। নারী দিবস উপলক্ষে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে সাংসদ নাদিরা ইয়াসমিনকে প্রধান অতিথি করা হয়। দাপ্তরিক ব্যস্ততার কারণে সাংসদকে আমন্ত্রণপত্রটি দিতে একটু দেরি হয়। এ কারণেই সোমবার সকালে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শামসুন্নাহার তাঁকে ফোন করে বিষয়টি জানতে চান। মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সাংসদ ফোনটি নিয়ে ক্ষিপ্ত স্বরে হুমকি দেন।

তিনি পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ছিলেন। সেখানে তিনি ফোনটি রেখে ওয়াশরুমে গিয়েছিলেন। কেউ তাঁর ফোন থেকে এমন কল করতে পারেন। বিষয়টি তাঁর জানা নেই।
শামসুন্নাহার, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান, পাবনা সদর উপজেলা পরিষদ

আলোচনা সভায় মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা কানিজ আইরিন জাহান বলেন, ‘ভুলত্রুটি পেলে তিনি বকা দিতে পারেন, প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করতে পারেন। কিন্তু থাপ্পড় দেওয়ার কথা বলতে পারেন না।’ এ ঘটনায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘তাহলে নারী দিবস কেন আমরা করব? কতটুকু সম্মান আমাদের আছে? যে উনি (এমপি) আমাকে থাপ্পড় দিয়ে পাবনাছাড়া করবেন! আমি কী এখানে বাড়ির কাজ করতে এসেছি? সরকারই আমাকে বসিয়েছে। সরকারেরই একটা পর্যায় একটা পদে আমি আছি।’

কানিজ আইরিন জাহান প্রথম আলোকে বলেন, সাংসদের আত্মীয়স্বজনের মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরে কিছু সমিতি ছিল। নিয়মনীতি না মানায় সমিতিগুলো বাতিল করা হয়েছে। এ ছাড়া সাংসদ কিছু আবদার করেছিলেন। বিধিবহির্ভূত হওয়ায় সেগুলো রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। এ কারণেই সাংসদ ক্ষিপ্ত হয়ে এই হুমকি দেন বলে তিনি মনে করছেন।

অভিযোগের বিষয়ে মঙ্গলবার দুপুরে পাবনা প্রেসক্লাব মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করেন সাংসদ নাদিরা ইয়াসমিন
ছবি: প্রথম আলো

ঘটনা সাজানো বলে দাবি সাংসদ নাদিরার

পাবনা প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংসদ নাদিরা ইয়াসমিন পুরো ঘটনাই সাজানো বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা দুর্নীতিপরায়ণ, স্বেচ্ছাচারী। তিনি জেলায় দুর্নীতির রামরাজত্ব কায়েম করেছেন। নারীদের সম্মান করেন না। তাঁর কাছে কেউ গেলে অপমান, অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য করেন। এসব বিষয়ে বলার কারণেই তিনি অডিওর নাটক সাজিয়েছেন।

সাংসদ নাদিরা ইয়াসমিন বলেন, ‘সোমবার আমি তাঁকে (মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা) দুবার ফোন দিয়েছিলাম। তিনি আমার ফোন ধরেননি। পরে কার সঙ্গে কী কথা হয়েছে। কে তাঁকে কী বলেছেন, সেটা আমার জানা নেই।’
সংবাদ সম্মেলনে সাংসদের সঙ্গে জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক নীহার আফরোজ ও জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান শামীমা শিরিনসহ মহিলা আওয়ামী লীগের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে পাবনা সদর উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শামসুন্নাহার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি কাউকে ফোন দেননি। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে তখন তিনি পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ছিলেন। সেখানে তিনি ফোনটি রেখে ওয়াশরুমে গিয়েছিলেন। কেউ তাঁর ফোন থেকে এমন কল করতে পারেন। বিষয়টি তাঁর জানা নেই।

নারী দিবসের সভায় সভাপতিত্ব করেন পাবনার স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক মোখলেছুর রহমান। তিনি বলেন, মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা মৌখিকভাবে বিষয়টি জানিয়েছেন। তাঁরা বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানিয়েছেন।