নিজের ভাষার বর্ণমালা চেনে না তারা

রাখাইন পল্লির এসব শিশু নিজের ভাষায় লিখতে–পড়তে জানে না।
ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজার শহরের টেকপাড়ার মাঝিরঘাট এলাকার রাখাইন পল্লির মা ছিন রাখাইন (৬২)। স্থানীয় বার্মিজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক তিনি।
সড়কের উত্তর পাশ লাগোয়া একতলা পাকা বাড়ি মা ছিনের।

রোববার বিকেলে ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ভেতরে কাজে ব্যস্ত মা ছিন। সঙ্গে ছেলের বউ নি হ্লা ওয়ান। বাড়ির ছাদে খেলা করছিল ইলা ওয়ান, মুমু ওয়ান, প্রু প্রু ওয়ান, থিন থিনসহ কয়েকটি শিশু। তাদের সবার বয়স ১২ বছরের নিচে। সোমবার মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে নিজের স্কুলের হয়ে শহীদ মিনারে যাবে ওরা। ভাষাশহীদদের স্মরণ করতে গাইবে অমর একুশের গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। অথচ নিজের মাতৃভাষার (রাখাইন) বর্ণমালাও চেনে না এই শিশুরা। এর কারণ জানতে চাইলে থিন থিন (১২) জানায়, রাখাইন ভাষায় পড়াশোনার ব্যবস্থা নেই।

মা ছিন রাখাইন বলেন, পাকিস্তান আমল থেকে কক্সবাজার শহরসহ টেকনাফ, রামু, মহেশখালী, চকরিয়া, হারবাং, চৌফলদণ্ডী এলাকায় ১০টি বার্মিজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহশিক্ষা কার্যক্রম হিসেবে রাখাইন ভাষায় পাঠদান করা হতো। ১৯৭৪ সালের পর তা বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে কিছু বৌদ্ধমন্দির ও কিছু পরিবারে ব্যক্তি উদ্যোগে এ চর্চা চলছে। কিন্তু তা খুবই সীমিত।

রাখাইন ভাষার ৩৩টি বর্ণমালা।
ছবি: সংগৃহীত

রাখাইন বুড্ডিস্ট ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ওই পল্লির মং চেন হ্লা রাখাইন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দেশের ৪৫টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার একটি রাখাইন সম্প্রদায়। বিভিন্ন জেলায় রাখাইন সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা প্রায় ৯৮ হাজার। সবচেয়ে বেশি ৪৯ হাজার রাখাইনের বসতি কক্সবাজারে। কথা বলতে পারলেও তাঁদের ৯০ শতাংশ নারী–পুরুষ মাতৃভাষায় লিখতে–পড়তে জানেন না। এতে চোখের সামনে বিলুপ্তি ঘটতে চলেছে প্রাচীন এ ভাষার।

এর কারণ জানতে চাইলে মং চেন হ্লা রাখাইন বলেন, ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন বৌদ্ধবিহার এবং এলাকাভিত্তিক রাখাইন শিশুদের মাতৃভাষায় দক্ষতা বাড়াতে পাঠদান কেন্দ্র চালু ছিল। রাখাইন বুড্ডিস্ট ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন কেন্দ্রগুলো এর পরিচালনা করত। অর্থের অভাবে তা–ও বন্ধ হয়ে গেছে। রাখাইন ভাষার চর্চা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও গবেষণার জন্য রামুতে ২০১১ সালে ‘রাখাইন সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট’ নির্মাণ করা হয়েছিল। রাখাইনদের দানের ৫০ শতক জমিতে সরকারি তিন কোটি টাকায় নির্মিত হয় ইনস্টিটিউটটি। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে রামুর বৌদ্ধপল্লিতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর থেকে ওই ইনস্টিটিউটে অবস্থান নেয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এখনো বিজিবি সেখানে অবস্থান করছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মং চেন হ্লা বলেন, কেন্দ্রটি রাখাইনদের ছেড়ে দিতে অনেক লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু কাজ হচ্ছে না।

কক্সবাজার শহরের টেকপাড়ায় এক রাখাইন পরিবারে শিশুকে মাতৃভাষা শেখানো হচ্ছে।
ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজার সিটি কলেজের অধ্যক্ষ ক্য থিং অং শহরের টেকপাড়ার বাসিন্দা। তিনি বলেন, রাখাইন ভাষায় ৩৩টি বর্ণমালা আছে। রয়েছে বই-পুস্তকও। কিন্তু চর্চার সুযোগ নেই।

গত দশকের শুরুতে তিন বছরে আন্তর্জাতিক একটি উন্নয়ন সংস্থার সহযোগিতায় শহরে রাখাইন শিশুদের মাতৃভাষা চর্চার ব্যবস্থা ছিল জানিয়ে ক্য থিন অং বলেন, তখন পাঁচ শতাধিক শিশু পড়ত। বিদেশি অর্থায়ন বন্ধ হয়ে গেলে পাঠদানও বন্ধ হয়ে যায়।
রাখাইন ভাষা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন রামু বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক মং হ্লা প্রু পিন্টু। তিনি বলেন, ৯৬ শতাংশ রাখাইন শিশু-কিশোর মাতৃভাষায় কথা বলতে পারলেও লিখতে–পড়তে পারে না। অবশিষ্ট ৪ শতাংশ ছেলেমেয়ে মা–বাবার কাছে বা বৌদ্ধবিহারের পাঠাগারে গিয়ে মাতৃভাষা শিখেছে। রাখাইন শিক্ষকের অভাব, পাঠ্যপুস্তকের সংকট ও সরকারি উদ্যোগ না থাকায় রাখাইন ভাষার চর্চা থেমে গেছে। এতে রাখাইনদের সংস্কৃতি, সংগীত ও লোকগাঁথা হারিয়ে যাচ্ছে।

কক্সবাজার শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার উত্তরে খুরুশকুল ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডে একটি রাখাইন পল্লি রয়েছে, যেখানে ১১০ পরিবারে পাঁচ শতাধিক রাখাইনের বসতি। রাখাইন নেতারা বলেন, ৯৮ শতাংশ রাখাইন নিজের ভাষায় লিখতে পারে না। এ ছাড়া দেশের পটুয়াখালী, বরগুনা, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও চট্টগ্রাম মহানগরে রাখাইনদের বসতি আছে। এসব পল্লিতেও রাখাইন ভাষাচর্চার সুযোগ নেই।

কক্সবাজার মডেল হাইস্কুলের শিক্ষক ও গবেষক মা উন টিন বলেন, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে গিয়ে রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষ চলমান শিক্ষার দিকে ঝুঁকছে। রাখাইন শিশুদের অনেকের মাতৃভাষা শেখার ইচ্ছা থাকলেও ব্যবস্থা নেই। ফলে বিলুপ্তি ঘটছে এ ভাষার।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম কক্সবাজার জেলার সাধারণ সম্পাদক মং থে হ্লা রাখাইন বলেন, সরকার ছয়টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় বই প্রকাশ করেছে, যা প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তির পরিকল্পনা আছে। কিন্তু সেখানে রাখাইন ভাষা নেই।

কক্সবাজারের সাবেক সাংসদ (সংরক্ষিত) এথিন রাখাইন বলেন, মাতৃভাষার চর্চা না থাকায় রাখাইনদের ইতিহাস-ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহশিক্ষা হিসেবে রাখাইন ভাষা পড়ানো দরকার।