নিরাময় কেন্দ্রে নানা অনিয়ম

মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র পরিচালনার শর্ত মানছেন না পরিচালকেরা। নিবন্ধন ছাড়াই গড়ে উঠছে অনেক কেন্দ্র।

গাজীপুরের ভাওয়াল মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্র। অনিয়মের অভিযোগে সম্প্রতি এটি বন্ধ করে দেওয়া হয়
ছবি: প্রথম আলো

গাজীপুর মহানগরের ব্যবসায়ী আশরাফুল আকন্দ। দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে ভালোই ছিলেন। হঠাৎ কলেজপড়ুয়া বড় ছেলের পরিবর্তন দেখেন বাড়ির লোকজন। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন ছেলে মাদকে জড়িয়ে পড়েছে। নিরুপায় হয়ে ছেলেকে নিয়ে যান একটি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। বাড়িতে ফিরে সে জানায়, নিরাময় কেন্দ্রেই ইয়াবাসহ সব ধরনের মাদক পাওয়া যেত।

এ ঘটনা প্রায় এক বছর আগের। অভিযোগ ওঠা নিরাময় কেন্দ্রটি গাজীপুর নগরের তেলিরপাড়া এলাকায় অবস্থিত। এমন প্রায় অর্ধশত মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র গড়ে উঠেছে গাজীপুর সিটি করপোরেশন ও উপজেলাগুলোতে। কিছু প্রতিষ্ঠানের সরকারি নিবন্ধন থাকলেও বেশির ভাগের নেই। এসব কেন্দ্র ঘিরে নানা অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, তাদের হিসাবে জেলায় ২৩টি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে। এগুলোর মধ্যে সঠিক চিকিৎসাব্যবস্থা না থাকা এবং নানা অভিযোগ ওঠায় পাঁচটি কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়। সর্বশেষ গাজীপুরের হেমন্তপল্লী এলাকার ভাওয়াল মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রটি অভিযান চালিয়ে বন্ধ করা হয়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০০৫ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের বিধিমালা অনুযায়ী প্রতিটি নিরাময় কেন্দ্রে সার্বক্ষণিক চিকিৎসক, মনোবিদ, নার্স, ওয়ার্ডবয় ও সুইপার থাকতে হয়। রোগীদের সরবরাহ করা খাবারের তালিকা, মানসিক বিনোদনের প্রয়োজনীয় উপকরণ ও ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের সুবিধা, প্রয়োজনীয় শৌচাগার, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধপত্র, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, প্যাথলজিক্যাল ল্যাব. এবং রোগীদের কাউন্সেলিংয়ের জন্য ক্লাসরুম থাকার বিধান রয়েছে।

বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গাজীপুরে হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে ইয়াবাসহ নানা ধরনের মাদক। ধনী ও প্রভাবশালীদের সন্তানেরা নানাভাবে মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। তাঁরা সন্তানদের মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করে দিচ্ছেন। এই সুযোগে গড়ে উঠেছে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র। হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া বেশির ভাগ কেন্দ্রের অনুমোদন নেই। নেই অভিজ্ঞ চিকিৎসক, কর্মী ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজনীয় উপকরণ।

মৌচাক এলাকায় তিন বছর আগে একটি আবাসিক ভবন ভাড়া নিয়ে ‘মৌচাক মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র’ গড়ে তুলেছেন ফখরুল ইসলাম। তিনিসহ কেন্দ্রের আটজন কর্মীই ছিলেন মাদকাসক্ত। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পাঠানো প্রতিবেদনে ১০ শয্যায় ১০ জন থাকার কথা উল্লেখ করলেও বাস্তবে ১০ শয্যায় ২০ জন রোগী রেখেছে ওই কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ।

মৌচাক এলাকার বাসিন্দা মাহবুবুর রহমান বলেন, তারা সেখানে চিকিৎসার নামের রোগীদের শুধু আটকিয়ে রাখছে। কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। তবে ফখরুল ইসলাম বলেন, তাঁরা চেষ্টা করেন নিয়ম মেনেই পরিচালনা করার। কিন্তু সব নিয়ম মানলে নিবাসীরা কথা শুনতে চান না। এ জন্য তাঁদের মাঝেমধ্যে কঠোর হতে হয়।

কালিয়াকৈর বাজারের নিউ অঙ্গীকার মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে কয়েক মাস আগে ‘নির্যাতন সইতে না পেরে’ ছাদে উঠে তুরাগ নদে ঝাঁপ দেন এক তরুণ। তিন দিন পরে ওই নদ থেকে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। কেন্দ্রটির মালিক মামুন বলেন, তাঁরা ভেতরের পরিবেশ ঠিক রাখার চেষ্টা করেন। ওই তরুণ পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, নির্যাতনের অভিযোগ সঠিক নয়।

র‌্যাব সূত্রে জানা গেছে, চলচ্চিত্র অভিনেতা অনিক রহমানকে গাজীপুরের ভাওয়াল মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রে ভর্তি করেছিল পরিবার। কিন্তু সেখানে নিয়মিত তাকে শারীরিক নির্যাতন করা হতো, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হতো না। সব৴শেষ একজন রোগীর আত্মীয়ের মুঠোফোন থেকে ফোন করে তিনি নির্যাতনের বর্ণনা দেন শিল্পী সমিতিতে। এরপর ৪ জানুয়ারি র‌্যাব ও গাজীপুর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা যৌথ প্রতিষ্ঠানটিতে অভিযান চালিয়ে তাঁকে উদ্ধার করেন। ওই ঘটনায় কেন্দ্রের পরিচালক ফিরোজা নাজনিনসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেন র‌্যাব।

গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক সাইফুল ইসলাম বলেন, মাদকসেবীদের নিয়মিত চিকিৎসা ও কাউন্সেলিং করা প্রয়োজন। কিন্তু গাজীপুরের অধিকাংশ মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে সেই ব্যবস্থা নেই। তাই প্রশাসনকে এসব কেন্দ্রের বিষয়ে নিয়মিত খোঁজখবর রাখতে হবে।

জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক শামীম হোসেন বলেন, অনেকে শর্ত পালন করলেও বেশির ভাগই নিবন্ধনের শর্ত শতভাগ মানছেন না। রোগীদের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা কোনো অভিযোগ দিতে চান না। শর্ত অমান্য করায় এরই মধ্যে পাঁচটি নিরাময় কেন্দ্রের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।