নির্মাণাধীন ছয়তলা ভবনে ১৫ দিন ধরে আছে ৪৭ পরিবার

গাদাগাদি করে এই ভবনে ৪৭ পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন
ছবি: প্রথম আলো

নির্মাণাধীন ভবনটির ছয়তলা পর্যন্ত শুধু ছাদ দেওয়া। দেয়ালে ইটও লাগেনি। তাই ভবনটির চারদিকেই খোলা। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার ওয়েজখালি এলাকায় সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কের পূর্বপাশে এই ভবনের অবস্থান।

বন্যা যেদিন ভয়াবহ রূপ নেয়, সেদিন আশপাশের এলাকার ১১৭টি পরিবার আশ্রয় নেয় এখানে। এরপর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলে প্রায় অর্ধেক পরিবার বাড়ি ফিরে যায়। তবে আবার পানি বাড়ায় আজ বৃহস্পতিবার সকালে আবার সাতটি পরিবার এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে। এখন সব মিলিয়ে এই ভবনের ছয়তলাজুড়ে আছে ৪৭টি পরিবার।

আজ ওই ভবনে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের দোতলা থেকে পাঁচতলা পর্যন্ত বন্যাকবলিত মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। নিচতলার বেশির ভাগ অংশে শতাধিক গরু-ছাগল রাখা। তবে ছয়তলার অংশটি ফাঁকা পড়ে আছে। ভবনের একেকটি তলায় ত্রিপল ও কাপড় দিয়ে ভাগ করে পরিবারগুলো বাস করছে। কোনো কোনো অংশে একাধিক পরিবারও থাকছে।

ওয়েজখালি গ্রামের বাসিন্দা মিজানুর রহমান (৪৮) বলেন, তিনি হাওরে মাছ ধরে সংসার চালান। সংসারে স্ত্রী, দুই ছেলেমেয়ে, মা আর দুই ভাই আছেন। বোরো মৌসুমে অন্যের জমি বর্গাচাষ করেন। ১৬ জুন সকালে বন্যার পানিতে যখন বাড়িঘর তলিয়ে যায় তখন সবাইকে নিয়ে প্রথমে এলাকার স্কুলে যান। কিন্তু বিকেলে ওই স্কুলেও পানি ওঠে। পরে এই ভবনের খবর পেয়ে তাঁরা এখানে আশ্রয় নিয়েছেন।

ভবনের দ্বিতীয় তলার পূর্বকোণে ত্রিপল আর কাপড়ের বেড়া দিয়ে নিজেদের জায়গা করেছেন তাঁরা। মিজানুর বলেন, ‘চারটি পরিবার একসঙ্গে আছেন। খেয়ে, না খেয়ে দিন যাচ্ছে। এক দিন কিছু চাল-ডাল আর দুই দিন ভবনের মালিকের পক্ষ থেকে খিচুড়ি দেওয়া হয়েছিল। এরপর আর কিছু পাইনি।’

হাওরের ঢেউয়ে আরিফুল নেছার (৫০) ঘর তছনছ হয়ে গেছে। তাঁর স্বামী নেই। সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে আরিফুল নেছা কেঁদে ফেলেন। তিনি বলেন, ‘আমার তো আর যাওয়ার ঘর নাই। ঘর-দুয়ার সবতা ভাইসা গেছে। আমার কুনতা রইছে না। দুই মেয়ে নিয়া অখন কোয়াই যাইমু।’

ঘর থেকে পানি নামায় গত সোমবার সকালে আলী আহমদের (২৮) পরিবারে এই ভবন ছেড়ে চলে যায়। এখন আবার পানি বাড়ায় আজ সকালে তাঁরা এখানে ফিরে এসেছেন। আলী আহমদ বলেন, ‘পানি তো ঘরের নাকে নাকে আইগিছে। ভয়ে দিন থাকতে ঘর ছাইড়া আইছি। রাইতে যদি আগের লাখান অবস্থা হয় অয়, তাইলে ঘরেই মরত অইব।’

ভবনের দ্বিতীয় তলায় চেয়ারে বসা ছিলেন নুরুল গণি (৬৫)। ১৬ জুন নুরুল গণি পরিবার নিয়ে এখানে ওঠেন। ১৮ জুন বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা থেকে নুরুল গণির দুই বোন জমিরুন বেগম (৪০) ও সাজিরুন বেগম (৩৮) এই ভবনে আশ্রয় নেন। দুই পরিবারে ১০ সদস্য একসঙ্গে দিন কাটাচ্ছেন।

নুরুল গণি বলেন, ‘এখানে খোলা পরিবেশে থাকা খুবই কষ্টকর। রাত হলে হাওরের বাতাস, ঝড়, বৃষ্টি এসে লাগে। চারদিক খোলা। এ জন্য বাচ্চারাও ভয় পায়। যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।’

সুনামগঞ্জে ১৬ জুন থেকে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। মাঝখানে এক সপ্তাহ বিরতি দিয়ে আবার ২৭ জুন থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। একই সঙ্গে সুনামগঞ্জের উজানে ভারতের মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি হওয়ায় নামছে পাহাড়ি ঢল। এতে আবার পানি বাড়তে শুরু করেছে। গত তিন দিনে সুরমা নদীর পানি ৩২ সেন্টিমিটার বেড়েছে।