নিষেধাজ্ঞায়ও উপচে পড়া ভিড়

করোনা পরিস্থিতিতে পর্যটনকেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত আছে। তবে ঈদের এই সময়ে তা মানেননি অনেকে।

চা-বাগানে পর্যটকদের ঢল। শনিবার বিকেলে সিলেটের লাক্কাতুরা চা-বাগানে
ছবি: প্রথম আলো

করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সারা দেশের পর্যটন ও বিনোদনকেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। তবে ঈদের ছুটির এই সময়ে সেই নির্দেশনা মানেননি অনেকে। সিলেট, মৌলভীবাজার ও কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে ভিড় জমাচ্ছেন মানুষজন।

করোনার বিস্তার ঠেকাতে নানা পদক্ষেপের পাশাপাশি সরকার ৩১ মার্চ থেকে পর্যটন ও বিনোদনকেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখার নির্দেশনা জারি করে। ওই বিধিনিষেধ অমান্য করে এখন সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর ও জেলার বিভিন্ন এলাকার চা-বাগানগুলোতে ভিড় করছেন প্রচুর মানুষ।

এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, ৩১ মার্চের পর থেকে ভোলাগঞ্জে পর্যটকদের আনাগোনা ছিল না বললে চলে। দু-একজন এলেও চলেনি কোনো যাত্রীবাহী নৌকা। ফলে আগত পর্যটকেরা ভোলাগঞ্জ ঘাট থেকে ফিরে গেছেন। সেই পরিস্থিতি বদলাতে থাকে গত শনিবার দুপুর থেকে। ওই সময়ে ভোলাগঞ্জে ভিড় জমান প্রচুর মানুষ। তাঁদের অধিকাংশই সিলেটের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা। অন্যান্য জেলা থেকেও কমবেশি মানুষজন ঈদের ছুটিতে ঘুরতে আসছেন। তাঁদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো লক্ষণ ছিল না। স্থানীয় প্রশাসনকেও এ ব্যাপারে নীরব থাকতে দেখা গেছে।

কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কে এম নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা পর্যটকদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য প্রচারণা চালাচ্ছি।’

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুমন আচার্য বলেন, ‘হঠাৎই শনিবার থেকে স্থানীয় পর্যটকেরা ভোলাগঞ্জে ভিড় জমাচ্ছেন। আমরা মানুষজনকে ভিড় করতে নিরুৎসাহিত করছি। স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্বের বিষয়ে সচেতন থাকতে প্রচারণা চালাচ্ছি।’

হাওরপাড়ে পর্যটকদের ভিড়। শনিবার বিকেলে কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলায়
ছবি: প্রথম আলো

অন্যান্য পর্যটনকেন্দ্র বন্ধ থাকায় সিলেটের চা-বাগানগুলোতে মানুষজনের ঢল নামছে। বেশির ভাগ মানুষ যাচ্ছেন মালনীছড়া, লাক্কাতুরা চা-বাগান, তারাপুর চা–বাগান লাগোয়া গোয়াবাড়ি ‘ওয়াকওয়ে’ এলাকায় । চা-বাগানে ঘুরতে আসা ব্যক্তিরা বলছেন, পর্যটনকেন্দ্রগুলো বন্ধ থাকায় ঈদের ছুটি কাটাতে পরিবার–পরিজন নিয়ে শহরের আশপাশের চা–বাগানে ঘুরছেন তাঁরা। সবখানেই স্বাস্থ্যবিধি মানতে উদাসীনতা লক্ষ করা যাচ্ছে।

তারাপুর চা–বাগান এলাকায় ঘুরতে আসা সাইদ আহমদ বলেন, ‘পর্যটনকেন্দ্রগুলো বন্ধ থাকায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে শহরের পাশেই এই ওয়াকওয়েতে ঘুরতে এসেছি।’ মাস্ক না পরার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছবি তোলার জন্য মাস্ক খুলেছেন। ছবি তোলা হয়ে গেলেই মাস্ক পরে নেবেন।

জাফলংয়ে যেতে বাধা

সিলেটের আরেক পর্যটনকেন্দ্র জাফলংয়ে যেতে মানুষজনকে নিরুৎসাহিত করতে প্রচারণা চালাচ্ছে টুরিস্ট পুলিশ ও থানা-পুলিশ। জাফলংয়ের প্রবেশপথে একাধিক তল্লাশিচৌকি বসিয়ে পর্যটকদের ফিরিয়ে দিচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা। জাফলংয়ের প্রবেশপথ গোয়াইনঘাটের বিছনাকান্দি, নলজুরি, জিরো পয়েন্ট, বল্লাঘাট এলাকায় ঈদের দিন থেকে এসব তল্লাশিচৌকি বসানো হয়েছে।

টুরিস্ট পুলিশ জাফলং সাব–জোনের পরিদর্শক রতন শেখ বলেন, জাফলংয়ে প্রবেশের আগেও পর্যটকদের আটকে দেওয়ার চেষ্টা করছে পুলিশ। করোনা পরিস্থিতি নিয়ে ঝুঁকির কথা তুলে ধরে বুঝিয়ে পর্যটকবাহী যানবাহন ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

হাওরে ভিড়, গোসলে নেমে মৃত্যু

নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে এবারের ঈদে কিশোরগঞ্জ হাওরে বিপুলসংখ্যক পর্যটক ভিড় জমিয়েছেন। ঈদের দিন থেকে জেলার বিভিন্ন প্রান্ত ও দূরদূরান্ত থেকে অসংখ্য পর্যটক হাওর-অধ্যুষিত নিকলী, ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও করিমগঞ্জ উপজেলায় ভিড় করেন। ঈদের পরের দিন গত শনিবার বন্ধুদের সঙ্গে মিঠামইনের হাওরে ঘুরতে এসে গোসলে নেমে একজনের মৃত্যু হয়েছে।

পুলিশ জানায়, মৃত ব্যক্তির নাম মাজহারুল ইসলাম (২৮)। তিনি করিমগঞ্জ উপজেলার জাফরাবাদ ইউনিয়নের সাইটুটা গ্রামের মৃত আজিম উদ্দিনের ছেলে। তিনি ঢাকায় একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। ঈদের ছুটিতে বাড়িতে এসেছিলেন তিনি।

প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, শনিবার বিকেলে মিঠামইনের ঢাকী সেতুর নিচে পাঁচ বন্ধু গোসল করতে নামেন। একপর্যায়ে মাজহারুল নিখোঁজ হন। দুই ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে সন্ধ্যার আগে স্থানীয় ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল মাজহারুলের লাশ উদ্ধার করেছে বলে জানিয়েছেন মিঠামইন ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের কর্মকর্তা আল-আমিন।

মিঠামইন থানার ওসি জাকির রাব্বানী বলেন, পরিবারের লোকজন নদীপাড়ে এসে লাশটি মাজহারুলের বলে শনাক্ত করেন।

এদিকে শুধু যাত্রীবাহী গাড়ি নয়, মালবাহী ট্রাক্টর ও পিকআপ ভ্যানে নেচে-গেয়ে মানুষ হাওরে বেড়াতে যাচ্ছেন। বেশির ভাগ মানুষের মুখে মাস্ক থাকে না। কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো নজরদারি নেই। তাই হাওরে জনসমাগম এড়াতে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন স্থানীয় লোকজন।

নিকলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আসসাদিক জামান বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম চলমান আছে। পাশাপাশি মানুষকেও সচেতন হতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গলেও উপচে পড়া ভিড়

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মাধবপুর লেক ও বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহি হামিদুর রহমান স্মৃতিসৌধ এলাকায় পর্যটক নিষিদ্ধ। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের প্রবেশ ফটক বন্ধ থাকায় ভেতরে প্রবেশ করতে পারছেন না পর্যটকেরা। তবে উদ্যানের ভেতর দিয়ে গেছে কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল সড়ক। ওই সড়কের পাশের পাহাড়ি পথ আর মাধবপুর চা–বাগান লেকসহ বিভিন্ন এলাকায় উপচে পড়া ভিড় থাকছে পর্যটকদের। তাঁরা মানছেন না কোনো স্বাস্থ্যবিধি। মাধবপুর লেক এলাকায় ঈদের দিন দুপুরের পর থেকে শুরু করে গতকাল বিকেল পর্যন্ত মোটরসাইকেল, ব্যক্তিগত গাড়ি ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে অনেকে চলে আসছেন।

গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় ও অন্যান্য জেলা থেকে আসা প্রচুরসংখ্যক পর্যটককে ঘুরতে দেখা গেছে। বেশির ভাগ পর্যটক আসছেন ব্যক্তিগত যানবাহনে। তাঁরা চা–বাগানসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অনেকেরই মুখে মাস্ক থাকছে না। বিভিন্ন চা–বাগানের পাশাপাশি চা–কন্যা ভাস্কর্য, বিটিআরআই ইত্যাদি এলাকা রয়েছে পর্যটকদের পছন্দের শীর্ষে।

সিলেট শহর থেকে শ্রীমঙ্গলে এসেছিলেন জামাল মিয়া। তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে অনেক দিন পরিবার নিয়ে আমি ঘুরতে বের হতে পারিনি। তাই এই ঈদের ছুটিতে বের হয়েছি।’

শ্রীমঙ্গল থানার পরিদর্শক (অপারেশন) নয়ন কারকুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ঈদের দিন থেকেই উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় পুলিশি টহল জোরদার করেছি। যাঁরা আসছেন, তাঁদের গাড়ি থামিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য বলছি।’

[প্রতিবেদনের তথ্য দিয়েছেন প্রতিনিধি, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল]