ন্যায়বিচারের আশায় মৃণালিনী সুশীল

শোকে পাথর মৃণালিনী সুশীল ওরফে মানু রানী (চেয়ারে বসা)। শনিবার দুপুরে কক্সবাজারের চকরিয়ার মালুমঘাটের সোয়াজনিয়াপাড়ায়
ছবি: প্রথম আলো

পিকআপের চাপায় একসঙ্গে হারিয়েছেন ছয় ছেলেকে। এর ১০ দিন আগে স্বামীকেও। শোকস্তব্ধ মৃণালিনী সুশীল ওরফে মানু রানীর (৬২) এখন একটাই দাবি, সন্তান হত্যার বিচার।

মৃণালিনী সুশীল প্রথম আলোকে বলেন, অনেকে আসছেন তাঁদের বাড়িতে। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন কেউ কেউ। কিন্তু এসব দিয়ে কী হবে? ছয় সন্তানকে তো আর ফিরে পাবেন না। যারা তাঁর সন্তানদের প্রাণ কেড়ে নিল, তাদের বিচার চান তিনি। এ ঘটনাকে কোনোভাবেই দুর্ঘটনা হিসেবে মানতে নারাজ মৃণালিনী। ছেলেদের হত্যা করা হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

আজ শনিবার দুপুরে কক্সবাজারের চকরিয়ার মালুমঘাটের সোয়াজনিয়াপাড়ায় মৃণালিনী সুশীলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, দূর থেকে আসা লোকজনের উপস্থিতি। সবাই শোকাচ্ছন্ন। উঠানের উত্তর দিকে টিনশেডের আধা পাকা বাড়ি। সামনের তিন দিকের সীমানায় টাঙানো আছে নিহত ছয় ভাইকে নিয়ে শোকের একাধিক ব্যানার।

মৃণালিনী বলেন, এটা ছিল হত্যাকাণ্ড। পিকআপ সবাইকে (সন্তানদের) একবার চাপা দিয়ে যায়, কিছুক্ষণ পর আবার পেছনের দিকে গিয়ে দ্বিতীয়বার চাপা দেয়। তাঁর দুই মেয়ে এই দৃশ্য দেখেছেন। আক্ষেপের সুরে মৃণালিনী বলেন, ‘সব হারালাম, এ বয়সে কাকে নিয়ে বেঁচে থাকব, দিশা খুঁজে পাচ্ছি না।’

নিহত নিরুপম সুশীলের স্ত্রী গীতা রানী সুশীলের চোখে পানি। কথা বলতে পারছিলেন না তিনি। একপর্যায়ে বলেন, ‘কী অপরাধ করেছিলাম জানি না। পিকআপের চালকের ফাঁসি চাই।’

নিহত অনুপম সুশীলের স্ত্রী পপি সুশীলের মনেও ক্ষোভ। কাছে যেতেই বলে উঠলেন, ‘আমরা পিকআপচালকের ফাঁসি চাই। এত দিনেও বিচার হচ্ছে না কেন?’

দুই ছেলে–মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে মা পপি সুশীল বলেন, তাঁর স্বামী অনুপম সুশীল পল্লিচিকিৎসক ছিলেন। চট্টগ্রামের আজিজনগর বাজারে তিনি রোগী দেখে সংসার চালাতেন। প্রতি মাসে ৭-৮ হাজার টাকা সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ জোগাতেন। এখন তিনি নেই। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ, সংসার চালাবেন কী দিয়ে, ভেবে পাচ্ছেন না তিনি।

বাড়ির সীমানায় টাঙানো আছে নিহত ছয় ভাইকে নিয়ে শোকের একাধিক ব্যানার
ছবি: প্রথম আলো

৮ ফেব্রুয়ারি ভোরে মালুমঘাট এলাকায় (চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে) পিকআপ চাপায় হাসিনাপাড়ার সুরেশ চন্দ্র সুশীলের পাঁচ ছেলে অনুপম সুশীল (৪৬), নিরুপম সুশীল (৪০), দীপক সুশীল (৩৫), চম্পক সুশীল (৩০) ও স্মরণ সুশীলের (২৯) মৃত্যু হয়। গুরুতর আহত রক্তিম সুশীলকে (৩২) ভর্তি করা হয় চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে। সেখান থেকে স্থানান্তর করা হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ)। ১৪ দিন পর সেখানে মারা যান রক্তিম সুশীলও। গুরুতর আহত হয়েছেন আরও এক ভাই প্লাবন সুশীল (২৫) ও বোন হীরা সুশীল (২৮)। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে সম্প্রতি প্লাবন সুশীল বাড়ি ফিরলেও মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। ঘটনার পর থেকে চকরিয়ার মালুমঘাট খ্রিষ্টান মেমোরিয়াল হাসপাতালে চিকিৎসা নেন হীরা সুশীল। পিকআপচাপায় তাঁর পা ও হাত ভেঙে গেছে।

এ ঘটনার ১০ দিন আগে ৩০ জানুয়ারি মারা যান তাঁদের বাবা সুরেশ সুশীল। ৮ ফেব্রুয়ারি ভোরে মালুমঘাটের একটি মন্দিরে বাবার শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠান শেষ করে ফেরার পথেই এ ঘটনা ঘটে।

ঘটনার পর আত্মগোপনে ছিলেন পিকআপচালক সাহিদুল ইসলাম প্রকাশ সাইফুল (২২)। ১২ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে সাইফুলকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। এরপর সাইফুলকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে মামলার তদন্তকারী সংস্থা মালুমঘাট হাইওয়ে থানা-পুলিশ। রিমান্ড শেষে সাইফুলকে পাঠানো হয় কারাগারে। এখন মামলাটি তদন্ত করছে পিবিআই।