পরিবারকে ফাঁকি দিয়ে পড়াশোনা করা সুলতানা আজ সফল

নিজ অফিসকক্ষে হাজী মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীন কর্মাস কলেজের অধ্যক্ষ সুলতানা পারভীন
ছবি: সোয়েল রানা

অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাল্যবিবাহের শিকার হন সুলতানা পারভীন। শ্বশুরবাড়ির রক্ষণশীল পরিবেশে গিয়ে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। গৃহশিক্ষকের অনুপ্রেরণায় স্বামী–শ্বশুরের চোখ ফাঁকি দিয়ে করেন মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস। সংসার ও সন্তান সামলে সম্পন্ন করেন ডিগ্রি ও স্নাতকোত্তর।

এখন সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল করছেন সুলতানা পারভীন। নিজ এলাকায় শ্বশুরের নামে গড়ে তুলেছেন কলেজ। সেখানে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন। একই ক্যাম্পাসে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন স্কুল। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েও দেশ-বিদেশে সম্মাননা পেয়েছেন এ নারী।
১৯৭৯ সালে বগুড়া শহরের চক সূত্রাপুর মহল্লায় সুলতানা পারভীনের জন্ম। তাঁর বাবা সহিদুল ইসলাম পেশায় ব্যবসায়ী; মা হোসনে আরা বেগম গৃহিণী। চার বোনের মধ্যে দ্বিতীয় তিনি।

নিজের বিয়ের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে সুলতানা পারভীন বলেন, ‘নানা ছিলেন বগুড়া সদর উপজেলার এরুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। তাঁর সঙ্গে সখ্য ছিল বগুড়া শহরের ব্যবসায়ী মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীনের। তাঁর ছেলে রবিউল ইসলামের সঙ্গে আমার বিয়ে পাকা করেন নানাজান। বিয়ে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই।’

৮০ ভরি স্বর্ণালংকারে সাজিয়ে শহরের কাটনারপাড়ায় শ্বশুরবাড়িতে নেওয়া হয় সুলতানা পারভীনকে। কিন্তু রক্ষণশীল পরিবারে গিয়ে জীবন পাল্টে যায়। সুলতানা পারভীন বলেন, শ্বশুরবাড়ি থেকে বিয়ের ডালার সঙ্গে বোরকা ও হিজাব পাঠানো হয়। ওই বাড়িতে যাওয়ার পর শুরু হয় বন্দিজীবন। পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ানোও নিষেধ। মা-বাবা ও বোন ছাড়া অন্য কোনো আত্মীয়ের সেখানে আসা নিষেধ। বাসার ল্যান্ডফোন থাকত লক করা। শ্বশুরের কড়া শাসনে স্বামীর সঙ্গেও ঘর থেকে বের হওয়া নিষেধ।

কয়েক মাস পর বাবার বাড়িতে বেড়াতে গেলে দেখা করতে আসেন গৃহশিক্ষক আবুল হোসেন। তাঁকে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছার কথা জানান সুলতানা পারভীন। এরপর গোপনে স্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে এক সেট বই কিনে দেন আবুল হোসেন। সুলতানা কাপড়ের ব্যাগে সেই বই লুকিয়ে শ্বশুরবাড়িতে ফেরেন। গোপনে পড়াশোনা করতেন। স্বামী-শ্বশুর বাসায় আসার আগেই বই–খাতা লুকিয়ে ফেলতেন।

সুলতানা পারভীন বলেন, ‘বিপত্তি দেখা দিল পরীক্ষা আসার পর। ফরম পূরণ করতে স্কুলে যেতেই হবে। পড়াশোনার বিষয়টি শাশুড়ি আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। তিনি সায় দিলেন। তবে সাবধান করলেন, কোনোভাবেই যেন শ্বশুর জানতে না পারেন। স্বামীকে বুঝিয়ে তাঁর সঙ্গে গিয়ে পরীক্ষায় অংশ নিলাম। এভাবে ১৯৯৫ সালে দ্বিতীয় বিভাগে মাধ্যমিক পাস করি। এরপর উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হলেও ক্লাস করা হয়নি। দুই বছর পর পরীক্ষা দেওয়ার কথা থাকলেও নানা জটিলতায় তা আটকে যায়। ১৯৯৮ সালে চিকিৎসক দেখানোর কথা বলে পরীক্ষায় অংশ নিই। ফল দ্বিতীয় বিভাগ।’

এরপর আরও মনোবল ও সাহস পান সুলতানা পারভীন। ভর্তি হন মহাস্থান ডিগ্রি কলেজে। ওই বছরের ডিসেম্বরে কন্যাসন্তানের মা হন। সংসার–সন্তান সামলে চালিয়ে যান পড়ালেখা। দ্বিতীয় সন্তান পেটে নিয়েই ডিগ্রি পরীক্ষায় অংশ নেন। পান দ্বিতীয় বিভাগ। ২০০২ সালে আরেক সন্তানের মা হন। শিশুসন্তান সামলে স্নাতকোত্তর পূর্বভাগে ভর্তি হন সরকারি আজিজুল হক কলেজে। এবার স্বামী বলেন, ‘অনেক তো হলো, এবার থামো।’

শ্রেণিকক্ষে ক্লাস নিচ্ছেন সুলতানা পারভীন
ছবি: সোয়েল রানা

সুলতান পারভীন বলেন, ‘মাস্টার্স পাস করা হলো। তত দিনে বই পড়ায় আসক্তি বাড়তে শুরু করে। ঘরের ভেতর গুনগুন করে আবৃত্তি করতাম। তত দিনে ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। আবৃত্তি শেখার ঝোঁক থেকে ২০০০ সালে দৃষ্টি বগুড়া নামে একটি সংগঠনে ভর্তি হই। বোরকায় মুখ ঢেকে আসা-যাওয়া করতাম। সঙ্গে শিল্পকলা একাডেমিতে গান শিখতে শুরু করি।’

সেসব দিনের স্মৃতিচারণা করে সংগ্রামী এ নারী বলেন, ‘মঞ্চে আবৃত্তির ডাক আসতে শুরু করল। অনুষ্ঠান শেষ করে বাসায় ফিরে গেট বন্ধ পেতাম। প্রাচীর টপকে বাসায় ঢুকতাম। শাশুড়ি সব জানতেন। এরপর ঢাকা ও রাজশাহী শিল্পকলা একাডেমিতে নিয়মিত আবৃত্তির অনুষ্ঠানে অংশ নিতে শুরু করি।’

২০০৯ সালেই এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে (এমবিএ) এবং ২০১০ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেন সুলতানা পারভীন। ২০১৬ সালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এমফিল কোর্সে। সেখানে মান্তা সম্প্রদায়ের ওপর গবেষণার কাজ করছেন।

সুলতানা পারভীন বলেন, ২০১২ সালে বগুড়ার সোনাতলা সরকারি নাজির আখতার কলেজে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ওই বছরই তাঁর শ্বশুর মারা যান। এরপর বিয়েতে পাওয়া গয়না বিক্রি করে এবং বাবার দেওয়া অর্থ দিয়ে শ্বশুরের নামে করেন হাজী মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীন কমার্স কলেজ। সুবিধাবঞ্চিত ছয়জন শিক্ষার্থী নিয়ে কলেজের কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে কলেজটির শিক্ষার্থীসংখ্যা ২৫০ জন। এ বছর তাঁর কলেজ থেকে ৬২ জন এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে ৬১ জন পাস করেন। ২০১৭ সালে একই ক্যাম্পাসে প্রতিষ্ঠা করেছেন বেগম হোসনে আরা বিদ্যালয়। সেখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০০।

আবৃত্তিতেও সাফল্য পেয়েছেন সুলতানা। গেছেন ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান ও মালয়েশিয়ায়। পেয়েছেন দেশি–বিদেশি সম্মাননা। ২৫০ সদস্য নিয়ে গড়ে তুলেছেন রক্তদানকেন্দ্র। বর্তমানে শিল্পকলা একাডেমি ও শিশু একাডেমির আবৃত্তি শাখার বিচারক তিনি।

সুলতানা পারভীনের স্বামী ব্যবসায়ী রবিউল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুলতানার এ পর্যন্ত আসার পেছনে রয়েছে ওর প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি। স্বামী হিসেবে আমি শুধু ওর স্বপ্ন পূরণে পাশে থেকেছি।’ তিনি বলেন, ‘আমার বাবা ছিলেন রক্ষণশীল। বাবার নামে কলেজ প্রতিষ্ঠা করে তাঁর প্রতি অন্য রকম শ্রদ্ধার পরিচয় দিয়েছে সুলতানা।’

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট বগুড়া জেলা শাখার সভাপতি তৌফিক হাসান বলেন, সাহস ও আত্মবিশ্বাস থাকলে একজন নারী যে সফলতার চূড়ায় পৌঁছাতে পারেন, সেটা সুলতানা দেখিয়েছেন।

বগুড়া স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি সামির হোসেন বলেন, ‘সুলতানা একজন ভালো সংগঠকও। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনে (বাপা) একসঙ্গে কাজ করেছি আমরা। পরে তিনি রোটারি ক্লাব অব বগুড়া, নারী, শ্রাবণী রক্তদানকেন্দ্রসহ নানা সংগঠনে নেতৃত্ব দেন।’