পাইকারি বাজারের ৫০ গজ দূরেই দ্বিগুণ দামে সবজি বিক্রি

রংপুরের তারাগঞ্জ হাটে বেগুন কিনে ঢাকায় বিক্রির জন্য বস্তায় ভরায় ব্যস্ত ব্যবসায়ীরা। গতকাল শুক্রবার তারাগঞ্জ হাটে
ছবি: প্রথম আলো

রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার দামোদরপুর গ্রামের কৃষক মিন্টু মিয়া ৪০ শতক জমিতে বেগুনের চাষ করেছেন। তারাগঞ্জ হাটের পাইকারি বাজারে খেতের তোলা বেগুন গতকাল শুক্রবার বিক্রি করতে এসেছিলেন। প্রতি কেজি বেগুন ৯ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছেন। অথচ ওই বাজারের ৫০ গজ দূরে খুচরা সবজি বাজারে দেখা গেছে উল্টো চিত্র। সেখানে প্রতি কেজি বেগুন বিক্রি হচ্ছে ১৮ টাকা দরে।

শুধু তারাগঞ্জে নয়, একই চিত্র বদরগঞ্জ উপজেলার সবজির হাটগুলোতেও। দুই উপজেলার খুচরা বাজারগুলোতে সব ধরনের সবজি চড়া দামে বিক্রি হলেও তাতে সবজিচাষিদের তেমন লাভ হচ্ছে না। মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছেন একশ্রেণির মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ী। হাত ঘুরলেই বাড়ছে সবজির দাম। এতে ঠকে যাচ্ছেন সাধারণ ক্রেতা ও সবজিচাষিরা।

শুক্রবার তারাগঞ্জ হাটে কথা হয় মিন্টু মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘স্থানীয় খুচরা বাজারে বেগুন কিনতে গেলে প্রতি কেজি ১৮-১৯ টাকার নিচে পাওয়া যায় না। এই বেগুন আবার ঢাকায় বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা কেজি দরে। বাজারে ফসলের দাম ঠিকই আছে। কিন্তু আমার মতো কৃষকেরা বেচতে গেলে দাম নেই। যেদিন লোকসান গুনতে গুনতে কৃষক আবাদ ছেড়ে দেবে, সেদিনই সরকারের টনক নড়বে।’

বদরগঞ্জ উপজেলার কাঁচাবাড়ি গ্রাম শফিকুল ইসলাম প্রতিবছর করলা চাষ করেন। গত বছর তাঁর ২৫ শতক জমির করলাখেত বৃষ্টির পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। এবারও তিনি করলার চাষ করেছেন। আজ শনিবার সকালে বদরগঞ্জের পাটানেরহাটে করলা বিক্রি করার সময় কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ভাই পাইকারের কন আর দোকানি কন। এমার সউগ সময় ধান্দা কেমন করি কৃষকোক ঠকা যায়। কেমন করি দুই টাকা কম দেওয়া যায়। এটা বুঝে না যে মাথার ঘাম পাওত ফেলে, রোদে পুড়ে আমরা ফসল ফলাই। এক মণ করলা নিয়া আসছিনু। তাক ২০ টাকা কেজি দরে পাইকারেরটে বেচে দিনু।’

বদরগঞ্জের আমরুলবাড়ি গ্রামের আরেক কৃষক ওয়াহেদ আলী বলেন, ‘হামার খালি খাটাখাটিই করা হয়। যা লাভ পাইকারের আর দোকানিরা পায়। হামারটে ওমরা বেগুন করলা কিনোছে ৮-২০ টাকা কেজি। আর ওমরা হামার মতোন মানুষেরটে বেচাওছে ১৮ থেকে ৩৫ টাকাত। চোখের সামনোত এমনতো করি ঠকুছি। তাও সরকারের কোনো লোক পদক্ষেপ নেওছে না।’

আজ তারাগঞ্জের চিকলী, খিয়ারজুম্মা, বুড়িরহাট, কাজীরহাট, ইকরচালী, ডাংগীরহাট ও বদরগঞ্জের কাচাবাড়ি, নাগেরহাট, শেখেরহাট, ট্যাক্সশোরহাট, পাটানের হাট, লালদীঘি হাটে গিয়ে দেখা যায়, পাইকারেরা কৃষকের কাছে প্রতি কেজি বেগুন ৮-৯, কাঁচা মরিচ ৯০-১০০, ফুলকপি ৬৫-৭০, করলা ২০-২২ টাকা দরে কিনে নিচ্ছেন। সেগুলো বস্তায় ভরে ট্রাকে করে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত করছে কেউ কেউ। খুচরা বাজারে বেগুন ১৮-১৯, কাঁচা মরিচ ১৪০-১৫০, ফুলকপি ১০০-১১০, করলা ৩৫-৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

তারাগঞ্জের ইকরচালী হাটে কথা হয়, কাঁচাবাজার করতে আসা মাটিয়ালপাড়া গ্রামের আবু মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ভাই সবজির বাজারে আগুন লাগছে। হাতে দেওয়া যাচ্ছে না। কয়দিন আগেও কাঁচা মরিচ প্রতি কেজি ৫০-৬০ টাকায় কিনেছি। এখন ১৪০ টাকা দরেও দিবার চাওছে না। ফুলকপি, করলার বাজারও চড়া। এমতোন করি সবজির দাম বাড়লে আমার মতো নিম্ন আয়ের মানুষ সংসার চালাতে হিমশিমে খাবে।’

খুচরা বাজারে কথা হয় কাঁচামাল ব্যবসায়ী দুলু মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, তাঁদের কাছে সরাসরি কৃষকেরা ফসল নিয়ে আসেন না। পাইকারেরা তাঁদের মালামাল সরবরাহ করেন। কেনা দামের থেকে দুই–এক টাকা লাভ ধরে তাঁরা ক্রেতার কাছে বিক্রি করছেন। কাঁচামালে সব সময় ঘাটতি থাকে, তাই দুই–এক টাকা বাড়িয়ে বিক্রি না করলে আমাদেরও লোকসান হবে। এ ছাড়া এখানকার অধিকাংশ কাঁচামাল ব্যবসায়ী ঢাকায় মাল পাঠান। ফলে তাঁদেরও চড়া দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে।

তারাগঞ্জ পাইকারি বাজার থেকে কাঁচামাল কিনে ঢাকায় পাঠান বসুনিয়াপাড়া গ্রামের মশিউর রহমান। তিনি বলেন, ‘ভাই, খালি কামাই দেখেন, খরচ দেখেন না। কাঁচামালের ব্যবসাত বড় ঝুঁকি। শ্রমিক খরচ, বস্তা, গাড়ি ভাড়াবাদ দিয়া দুই আড়াই হাজার টাকা ট্রাকে থাকে। অনেক সময় ট্রাক যানজটোত আটকি গেইলে কাঁচামাল পচি যায়। তখন তো লোকসান হয়। কেউ তো ক্ষতিপূরণ দেয় না। আমরা ন্যায্য দামে কৃষকের কাছে সবজি কিনে ঢাকায় পাঠাই, যা লাভ হয় তা দিয়ে সংসার চালাই।’