পাথরের বুকে নকশা ফোটান বাবু

পাথরের শিলপাটা ছেনি–হাতুড়ি দিয়ে কেটে বিক্রি ও ব্যবহার উপযোগী করেন বাবু হাওলাদার। খুলনা শহরের ভৈরব স্ট্যান্ড রোডের একটি দোকানে
ছবি: প্রথম আলো

ভৈরব নদের কোল ঘেঁষে খুলনা নগরের বাণিজ্যকেন্দ্রগুলো গড়ে উঠেছে। খুলনার ভৈরবতীরের ঘাট এলাকাগুলো তাই সকাল থেকেই ব্যস্ত হয়ে ওঠে। শহরের বড়বাজারের কালীবাড়ি রোড, ক্লে রোড আর ভৈরব স্ট্যান্ড রোডের সংযোগস্থলের মোড়ের ডেলটা ঘাট মোড়। বৃহস্পতিবার সকালে ডেলটা ঘাট মোড় এলাকা সরগরম ছিল লিচু ব্যবসায়ীদের হাঁকডাকে। ডেলটা ঘাটের পরের ঘাটের নাম জুতাপট্টি ঘাট। ওই ঘাটসংলগ্ন এলাকায় এখন আর জুতার ব্যবসা নেই। সেখানে এখন বেশ কিছু হার্ডওয়্যারের দোকান।

জুতাপট্টি ঘাটে দাঁড়াতেই অনবরত খটখট, খটখট ধরনের আওয়াজ কানে আসতে থাকল। দুই পাশে সারিবদ্ধ দোকানগুলো তখনো খোলেনি। সারবাঁধা দোকানের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া ভাঙাচোরা রাস্তা ধরে হাতে গোনা দু–একজন চলাফেরা করছেন। একটু সামনে এগোতেই শব্দের উৎস খুঁজে পাওয়া গেল। আঠারো-উনিশ বছরের এক যুবক বাইরে দাঁড়িয়ে ছেনি–হাতুড়ি দিয়ে পাথরের শিলপাটায় খোদাই করছিলেন। তাতেই ওই ছন্দোবদ্ধ শব্দ।

মুখে কালো মাস্ক পরা ছিপছিপে গড়নের যুবক একাগ্র চিত্তে পাথরের বুক খুঁড়ে চলেছেন। কোনো দিকে তাকানোর যেন অবসর নেই। দ্রুততার সঙ্গে শক্ত পাথরের বুকে নানা আকৃতির ফুল ফোটাচ্ছেন। কখনো আঁকছেন পাতা, কখনোবা পাথরের বুকে ফুটে উঠছে জ্যামিতিক নানান নকশা।

বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কাজ দেখার একপর্যায়ে কথা হলো। জানালেন, তাঁর নাম বাবু। পুরো নাম বাবু হাওলাদার। খাতা–কলমে অবশ্য সবুজ হাওলাদার লেখা আছে। তবে সবুজ নামে তাঁকে তেমন কেউ চেনে না। গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ হলেও জন্ম বেড়ে ওঠা খুলনাতেই। বাবুর বাবা হারেস হাওলাদার কর্মকারের কাজ করেন। রূপসার আইচগাতি ইউনিয়নের সেনের বাজারে একজনের জায়গার ওপর ঘর তুলে থাকেন। মাসে মাসে ওই জায়গার জন্য কিছু ভাড়া দেওয়া লাগে। বাবুরা ৫ ভাই আর ৪ বোন। ভাইদের মধ্যে বাবু তৃতীয়। বড় দুই ভাই লবণের কারখানায় কাজ করেন। ছোট দুই ভাইয়ের একজন থাই গ্লাসের মিস্ত্রি, অন্যজন শহরের খানজাহান আলী হকার্স মার্কেটে একটা শাড়ির দোকানে কাজ করেন।

পাথরে ঠুকাতে ঠুকাতে বাবু বলেন, ‘ক্লাস থ্রিতে ওঠার পর আর পড়িনি। পড়া খুব বেশি মনে থাকত না। আবার পরিবারে টাকার সমস্যা ছিল। সব মিলে পড়াশোনাটা হয়নি। পড়া ছাড়ার পর একটা মুড়ির মিলে কাজ করেছি দুই বছর। এরপর পরিচিত একজন শিলপাটার মহাজনের মাধ্যমে এখানে এসে শিলপাটা কাটার কাজ শিখেছি। শিলপাটা কাটতে হাতুড়ির পাশাপশি ‘গুজি ছেনি’ আর ‘ছাঁটনা ছেনি’ নামের দুই ধরনের ছেনি ব্যবহার করতে হয়। প্রথম দিকে দিনে একটাও কাটা হতো না। হাতে বাড়ি লাগত। এখন দিনে ৫০টা পারি।’

খুলনা ট্রেডিং অ্যান্ড হার্ডওয়্যার নামের একটি দোকানে বাবু মাসিক চুক্তিতে কাজ করেন। দুপুরে খাবার বিরতি বাদে সকাল নয়টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত তাঁকে দোকানে থাকতে হয়। মূলত দোকানের হার্ডওয়্যারের মালামাল বিক্রি করেন আর দোকানমালিক যখন দোকানে শিলপাটা আনেন, তখন সেগুলো কেটে দেন। এ ছাড়া সকালে দোকানে কাজে যোগ দেওয়ার আগের সময়টাতে অনেক দিন অন্য দোকনের শিলপাটা কেটে বাড়তি কিছু উপার্জন করেন।

বৃহস্পতিবার সকালেও তেমনি অন্যের দোকানের শিলপাটা কাটতে সকাল ছয়টা থেকে কাজ শুরু করেছিলেন বাবু। সকাল সাড়ে সাতটা পর্যন্ত দেড় ঘণ্টায় প্রায় ১২টা শিলপাটা কাটতে পেরেছিলেন।

বাবু বলেন, ‘এমনিতে দোকানে সকাল সাড়ে আটটার দিকে আসতে হয়। শিলপাটা কাটার দিন ছয়টার দিকে আসি। দোকান থেকে পাই আট হাজার টাকার মতো। এ ছাড়া এক বেলা খাওয়ার জন্য মহাজন ৫০ টাকা করে দেন। এর বাইরে শিলপাটা কাটার জন্য প্রতিটিতে ১৫ টাকা করে পাই। আশপাশের দু–একটা দোকানেও সময় করে শিলপাটা কেটে দিই। এ কাজ আবার প্রতিদিন হয় না। মহাজন ১০০ পিস মাল আনল, সেগুলো কাটলাম। পরে বিক্রি শেষ হলে আরও আসল। তখন আবার খুঁটালাম। এভাবে চলে।’

শিলপাটাগুলো কোথা থেকে আসে, জানতে চাইলে বাবু বলেন, ‘এগুলো ভারত থেকে আসে। ভোমরা বন্দর দিয়ে নোয়াপাড়া আসে পাথরের প্লেট আকারে। নোয়াপাড়ায় মিস্ত্রিরা কেটে সাইজ করে। আমরা এনে শিলপাটা কেটে (খুঁটিয়ে) বিক্রি করি।’

সব মিলিয়ে কেমন চলছে জানতে চাইলে বাবুর উত্তর, ‘সংসারে সবাই মিলে থাকি। আগে সংসারে অনেক দেনা ছিল। দেনা প্রায় শোধ হয়ে গেছে। সব ভাই ইনকাম করে। আমার বড় দুই ভাই আর ছোট একজনের বিয়ে হয়েছে। দুই বোনের বিয়ে এখনো হয়নি। সব মিলিয়ে সংসারে এখন অসুবিধা নেই। শুধু আমাদের কারও পড়ালেখাটা বেশি দূর এগোয়নি।’

ভবিষ্যতে শহরে একটা শাড়ির দোকান করতে চান বাবু। এ জন্য বেশ টাকার দরকার, তা–ও জানেন। তবে আয় থেকে সঞ্চয় করতে পারছেন না জানিয়ে বাবু বললেন, ‘ছোট ভাই শাড়ির দোকানে থাকে। ব্যবসাটা ভালো শুনেছি। অবশ্য শাড়ির দোকান করতে অনেক টাকার দরকার। এত দিন টাকা জমাতে পারিনি। কিন্তু এখন থেকে জমাব। জমাতে সময় লাগবে। তারপরও মানুষ তো ছোট থেকে বড় হয়। মাথায় যখন আছে, আস্তে আস্তে করব।’