পান বিক্রি করে সংসার চালান প্রতিবন্ধী রফিকুল

ফেরি করে পান বিক্রি করেন রফিকুল ইসলাম
ছবি: প্রথম আলো

সকাল গড়িয়ে ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর ১২টা। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী কলেজগেট এলাকায় যানবাহনের জটলা আর নানা শ্রেণিপেশার মানুষের ব্যস্ততা। কেউ হাঁটছেন, আবার কেউ দাঁড়িয়ে আছেন বাসের অপেক্ষায়। এর মধ্যে হঠাৎ এক ব্যক্তির হাঁকডাক কানে ভেসে এল।

পানের ডালা নিয়ে ক্রেতার অপেক্ষায় তিনি সড়কের পাশে আছেন। পাশ দিয়ে কোনো মানুষ হেঁটে গেলেই বলছেন, ‘মামা পান খাইয়্যা যান, পান খাইয়্যা যান।’ পান বিক্রেতা এই ব্যক্তি শারীরিক প্রতিবন্ধী। ঠিকমতো হাঁটাচলা করতে পারেন না। তবে যানবাহনের জটলা দেখলেই তিনি পান বিক্রির আশায় অনেকটা খুঁড়িয়ে ছুটে যাচ্ছিলেন যাত্রীদের কাছে। তবে পান বিক্রি না হলে পুনরায় মন খারাপ করে রাস্তার পাশে এসে আবার দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি।

পরিচয় দিয়ে কথা হয় ওই ব্যক্তির সঙ্গে। জানালেন, তাঁর নাম রফিকুল ইসলাম (২৮)। তাঁর পৈতৃক বাড়ি শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলায়। ছোটবেলায় একবার টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে তাঁর দুই পা খোঁড়া হয়ে যায়। তখন থেকে শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী তিনি। বয়স বাড়লেও তাঁর শারীরিক বৃদ্ধি ঘটেনি।

রফিকুল বলেন, তাঁর স্ত্রী ও এক কন্যাসন্তান (৪) রয়েছে। আগে পরিবার নিয়ে শেরপুরে মা–বাবার সঙ্গেই থাকতেন। কিন্তু আর্থিক টানাপোড়েনে তিনি স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে চলে আসেন গাজীপুরের টঙ্গীতে। এরপর জীবনধারণের জন্য পান ও সিগারেট বিক্রি শুরু করেন।

রফিকুলের বাবা কৃষক। তিনি শারীরিকভাবে অক্ষম হওয়ায় কোনো উপার্জন করতেন না। এত দিন বাবার আয়েই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে গ্রামে ছিলেন রফিকুল। তবে এখন রফিকুলের বাবাও সেভাবে কাজ করতে পারেন না। তাই শারীরিক অক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও জীবিকার তাগিদে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন রফিকুল। বর্তমানে রফিকুল টঙ্গীর সুরতঙ্গ সড়কের একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। তাঁর স্ত্রী পারভিন একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। দুজনের যা আয় হয়, তা দিয়েই টেনেটুনে সংসার চলে।

রফিকুল ইসলাম
ছবি: প্রথম আলো

রফিকুল বলেন, ‘আমাগোর বাসা ভাড়াই দেওন লাগে ৫ হাজার ট্যাকা। এর বাইরে খাওয়া, বাচ্চার দুধ, অন্যান্য খরচসহ মোট প্রতি মাসে ট্যাকা লাগে ১০ থেকে ১২ হাজার। এর মাঝে বউ গার্মেন্টস থেইক্যা বেতন পায় ৭ হাজার ট্যাকা। আমি পান-বিড়ি বেইচা মাসে আয় করতে পারি গড়ে ৫ থেকে ৬ হাজার ট্যাকা। এই আয় দিয়াই কোনো রকম সংসার চলে। এর মাঝে কারও অসুখবিসুখ বা বেচাবিক্রি কম হইল্যে বাইচা থাকাই কঠিন হইয়্যা পড়ে।’

পরপর চার কন্যাসন্তানের পর কৃষক মা–বাবার ঘরে অনেকটা ‘আকাঙ্ক্ষার ফল’ হয়ে জন্ম নিয়েছিলেন রফিকুল। তাকে ঘিরে স্বপ্ন ছিল অনেক। ছেলে বড় হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবে, সংসারের হাল ধরবে—এমনটাই ভাবতেন দরিদ্র মা–বাবা। কিন্তু অদৃষ্টের লিখনের মতো মাত্র চার বছর বয়সেই টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে সব হারান রফিকুল। পরিবারের হাল ধরা তো দূরের কথা, নিজের বেঁচে থাকা নিয়েই দেখা দিয়েছে সংশয়।

চিকিৎসায় রফিকুলের পা কিছুটা সুস্থ হলেও তার শারীরিক উচ্চতা বাড়েনি। রফিকুলের উচ্চতা ৪০ কিংবা ৪১ ইঞ্চি। পান বিক্রির পেশায় আসার আগে বিভিন্ন জায়গায় চাকরি জোগাড়ের চেষ্টা করেছেন তিনি। তবে শারীরিক গড়নের কারণে তাঁর চাকরি হয়নি। বরং বেশির ভাগ সময় তিনি নানা রকম অবহেলার পারিবারিকভাবে শিকার হয়েছেন।

রফিকুলের ভাষ্য, ‘চাকরির জন্য কোথাও গেলে সবাই শুধু আমার উচ্চতা নিয়ে কথা বলে। আমি খাটো, আমাকে দিয়ে হবে না—এসব নানা কারণে কেউ আমারে চাকরিতে নেয় নাই। হেললাইগ্যা উপায় না পাইয়া রাস্তার বাইর হইছি।’

কথা বলার একপর্যায়ে রফিকুল আলোচনা সংক্ষিপ্ত করতে চাইলেন। কারণ, ততক্ষণে প্রায় সাড়ে ১২টা বাজে। সন্ধ্যার মধ্যে তাঁর সব পান বিক্রি শেষ করতে হবে। অন্যথায় সংসারের খরচে টান পড়বে। তাই কথা বলে আর সময় নষ্ট করতে চাইলেন না রফিকুল। যাওয়ার আগে তাঁর ভাষ্য, ‘আমরা সমাজের অচল মানুষ। কোথাও আমাগোর দাম নাই। এই পান-বিড়ি বেইচাই আমাগোর দিন চালানো লাগব।’

রফিকুলের ভাষায়, ‘পরপর চার বইনের পর আমার জন্ম। আমারে নিয়া মা–বাবার অনেক স্বপ্ন আছিল। কিন্তু জ্বরই আমরে শেষ কইরা দিছে। পরিবারের হাল ধরমু তো দূরের কথা, উল্টা নিজেই পরিবারের বোঝা হইয়া ছিলাম। পরে দীর্ঘদিন চিকিৎসা করার পর এহন মোটামুডি হাঁটতে পারি। তাই আর মা–বাবার ঘরে বোঝা হইয়্যা না থাইক্যা রাস্তার বাইর হইছি। এহন কোনো রকম বউ-বাচ্চা লইয়্যা বাইচা আছি।’