পাবনায় থেমে নেই নিষিদ্ধ ‘চায়না দোয়ার’ উৎপাদন
মাছ ও পরিবেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় ‘চায়না দোয়ার’ নামের বিশেষ একধরনের জালের উৎপাদন ও বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান চালিয়েও পাবনার বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলায় বন্ধ করা যাচ্ছে না এই জালের উৎপাদন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেড়া উপজেলার চরপাড়া, সোনাপদ্মা, বাঘুলপুর; সাঁথিয়া উপজেলার আতাইকুলা, ডেমড়াসহ অন্তত ১০টি স্থানে এ ধরনের জালের কারখানা গড়ে উঠেছে। গত ৯ জুলাই বেড়া পৌর এলাকার চরপাড়া মহল্লার বিশ্বজিৎ হালদারের বাড়ির কারখানায় উপজেলা প্রশাসন অভিযান চালিয়ে চায়না দোয়ার জাল উদ্ধার করে পুড়িয়ে দেয়। অভিযানের পর কিছুদিন বন্ধ থাকার পর ওই কারখানায় আবারও জাল উৎপাদন শুরু হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সরেজমিনে ওই দুই স্থানে জাল তৈরির আলামতও দেখা গেছে। তবে তাঁরা দাবি করেন, না জেনে একসময় তাঁরা চায়না দোয়ার জাল তৈরি করতেন। কিন্তু এখন তাঁরা আর এটি তৈরি করেন না।
একসময় চীন থেকে এই জাল বাংলাদেশে আসত। চীন থেকে আমদানি হওয়ার কারণে স্থানীয়ভাবে এটির নাম দেওয়া হয় চায়না দোয়ার। পরে ঢাকাসহ পাবনার বেড়া ও সাঁথিয়ার কারখানায় চায়না দোয়ারের উৎপাদন শুরু হয়। পরে এই জাল নিষিদ্ধ করা হলেও এখনো পাবনায় দেদার চলছে এই জালের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার।
বিশ্বজিৎ হালদার ও নতুন ভারেঙ্গা ইউনিয়নের সোনাপদ্মা গ্রামের সুচিত্র হালদারের বিরুদ্ধে বাড়িতে কারখানা গড়ে এই জাল তৈরির অভিযোগ পাওয়া যায়। সরেজমিনে ওই দুই স্থানে জাল তৈরির আলামতও দেখা গেছে। তবে তাঁরা দাবি করেন, না জেনে একসময় তাঁরা চায়না দোয়ার জাল তৈরি করতেন। কিন্তু এখন তাঁরা আর এটি তৈরি করেন না। তবে বেড়া ও সাঁথিয়ার অনেক জায়গাতেই এ ধরনের জাল তৈরি হচ্ছে বলে তাঁরা জানান।
চায়না দোয়ার বেড়া উপজেলাসহ সারা দেশে অনেকটাই নতুন। বছর দুয়েক হলো এই ধরনের জাল দিয়ে দেশে মাছ ধরা শুরু হয়েছে। মূল কারখানায় সূক্ষ্ম জাল তৈরি করার পর তা স্থানীয় পর্যায়ের কারখানায় এনে গোলাকৃতি বা চারকোনা লোহার রড পরিয়ে খোপ খোপ করে বিশেষ ধরনের ফাঁদ তৈরি করা হয়। এই ফাঁদ উচ্চতায় দেড় থেকে ২ ফুট এবং লম্বায় ৫০ থেকে ৮০ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে।
চায়না দোয়ার জালের বৈশিষ্ট্য হলো, এ জাল নদীর তলদেশে লম্বালম্বিভাবে লেগে থাকে। কোনো রকমের টোপ ছাড়াই বিভিন্ন প্রজাতির মাছ দুই দিক দিয়েই এই জালের মধ্যে ঢুকে পড়ে। বড় মাছ থেকে শুরু করে পোনা মাছ, এমনকি মাছের ডিমও এই জালে সহজে আটকে যায়। ফলে এই জালে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
এদিকে চায়না দোয়ারের দাপটে হারিয়ে যেতে বসেছে এ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী মাছ ধরার উপকরণ বাঁশের চাঁই বা দেশি দোয়ার। বাঁশের চাঁইয়ের তুলনায় চায়না দোয়ারে কয়েক গুণ বেশি মাছ পাওয়া যায় বলে পেশাদার ও শৌখিন মাছশিকারিরা চাঁইয়ের পরিবর্তে চায়না দোয়ার কিনতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এর ফলে বাজারে চাঁইয়ের চাহিদা ব্যাপক কমে গেছে।
পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার সবচেয়ে বড় চাঁই বিক্রির বাজার বেড়া উপজেলার পাটপট্টিতে অবস্থিত। সম্প্রতি এই বাজার ঘুরে দেখা যায়, বিগত বছরগুলোর তুলনায় বাজারে চাঁইয়ের সরবরাহ অনেকাংশে কমে গেছে।
শুরুতে আমদানিনির্ভর হওয়ায় এই জাল আকারভেদে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি হতো। তবে এখন স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হওয়ায় ৫২ হাত দৈর্ঘ্যের একটি জাল ২ থেকে আড়াই হাজার টাকায় পাওয়া যায়।
চাঁই বিক্রি করতে আসা সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার রজব আলী জানান, ৩০ বছর ধরে তিনি চাঁই বানিয়ে বাজারে বিক্রি করছেন। কিন্তু চায়না দোয়ারের কারণে বাজারে চাঁই আর চলছে না।
এদিকে দুই উপজেলার বিভিন্ন বাজারে অবাধে চায়না দোয়ার বিক্রি হতে দেখা গেছে। শুরুতে আমদানিনির্ভর হওয়ায় এই জাল আকারভেদে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি হতো। তবে এখন স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হওয়ায় ৫২ হাত দৈর্ঘ্যের একটি জাল ২ থেকে আড়াই হাজার টাকায় পাওয়া যায়।
যমুনা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে বেড়ার রাকশা মাছবাজারের খাজনা আদায়কারী বাচ্চু মিয়া বলেন, বাজারে এখন যেসব মাছ আসছে, তার বেশির ভাগই চায়না দোয়ার দিয়ে ধরা। এই জালে যেভাবে মাছ নিধন চলছে, তাতে কয়েক বছরের মধ্যেই অনেক ধরনের মাছ হারিয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।
এ ধরনের জাল উৎপাদন বন্ধ করতে এর আগে অভিযান চালানো হয়েছে। তবে আবার এই জাল উৎপাদন শুরু হয়েছে, সেটি জানা ছিল না। শিগগির আবার অভিযান শুরু হবে।মোহা. সবুর আলী, ইউএনও, বেড়া
বেড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা শাহাদৎ হোসেন বলেন, চায়না দোয়ার জাল এ অঞ্চলে অনেকটাই নতুন। কারেন্ট জাল তৈরিতে যেসব উপকরণ ব্যবহৃত হয়, প্রায় একই ধরনের উপকরণ দিয়ে চায়না দোয়ার তৈরি করা হয়। ফলে এই জাল মাছ ও পরিবেশ উভয়ের জন্যই হুমকিস্বরূপ।
বেড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহা. সবুর আলী প্রথম আলোকে মুঠোফোনে বলেন, চায়না দোয়ার উৎপাদন ও বিপণন সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। এ ধরনের জাল উৎপাদন বন্ধ করতে এর আগে অভিযান চালানো হয়েছে। তবে আবার এই জাল উৎপাদন শুরু হয়েছে, সেটি জানা ছিল না। শিগগির আবার অভিযান শুরু হবে।