পা হারানো ভাসানীর অবলম্বন ইজিবাইকটি ছিনতাই, উদ্ধার হলো খণ্ড খণ্ড অংশ
জীবনের নানা উত্থান–পতনের পর ট্রাকচালকের সহকারীর কাজ শুরু করেছিলেন ভাসানী। এরপর শুরু করেন ট্রাক চালানো। এক দুর্ঘটনায় প্রাণে রক্ষা পেলেও তিনি পা হারান। তবু দমে যাননি; এক পায়েই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন পাড়া–প্রতিবেশীর টাকা তুলে কিনে দেওয়া একটি ইজিবাইককে অবলম্বন করে। সেই ইজিবাইকটিও ছিনতাই হয়ে যায় গত শনিবার সন্ধ্যায়।
একটি ফোন কলের সূত্র ধরে দুদিনের মাথায় পুলিশ যাত্রীবেশী ছিনতাইকারী দলের হোতাসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে। ইজিবাইকটি উদ্ধার না হলেও বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা হয়েছে ব্যাটারি, চাকাসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ।
ভাসানী প্রামাণিকের (৩৫) বাড়ি বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার সদর ইউনিয়নের ডহরপুর গ্রামে। গ্রেপ্তার আসামিরা আজ সোমবার বিকেলে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। আসামিরা হলেন নওগাঁ সদরের বরুণকান্দি গ্রামের বিদ্যুৎ হোসেন (৩২), বিদ্যুতের সহযোগী চোয়ারপুর গ্রামের মো. আবদুল মজিদ (৪০), ইজিবাইক ক্রেতা চোয়ারপুর গ্রামের খায়রুল ইসলাম (৩১) এবং ব্যাটারি ক্রেতা বর্ষাইল বাজারের আলি হাসান (৩৮)। পরে তাঁদের কারাগারে পাঠানো হয় বলে জানিয়েছেন বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) আলী হায়দার চৌধুরী।
ভাসানী প্রামাণিক প্রথম আলোকে বলেন, জন্মের আগেই তাঁর বাবা দবির উদ্দিন প্রামাণিক মারা যান। কিশোর বয়সেই সংসারের দায়িত্ব চাপে তাঁর ওপর। কিশোর বয়সে প্রথমে কিছুদিন রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করেছেন। এরপর ভ্যান চালিয়েছেন। দীর্ঘ কয়েক বছর ট্রাকচালকের সহকারীর কাজ করেছেন। পরে নিজেও ট্রাক চালিয়েছেন।
ভাসানী প্রামাণিক বলেন, ২০১৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বাঘাবাড়ি থেকে সারভর্তি ট্রাক চালিয়ে আদমদীঘির সান্তাহারে ফিরছিলেন। পথিমধ্যে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ট্রাকের সঙ্গে আরেকটি যানবাহনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান তিনি।
কিন্তু দুর্ঘটনার পর ডান পা কেটে ফেলতে হয়। পরে গ্রামেই ছোট্ট একটি মুদিদোকান দেন। কিন্তু দোকানের রোজগারে মা রওশন আরা (৫৫), স্ত্রী বিলকিস বেগম (২৮) ও এক বছরের সন্তানকে নিয়ে সংসার চলছিল না। ২০১৭ সালে পাড়া-প্রতিবেশিরা ১ লাখ ২০ হাজার টাকা তুলে একটি ইজিবাইক কিনে দেন। মাসে চার হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিল শোধ দেওয়ার পর গড়ে প্রতিদিন আয় ৩০০ টাকা। তা দিয়েই কোনো রকমে সংসার চলছিল।
ভাসানী প্রামাণিকের ভাষ্যমতে, গত শনিবার সন্ধ্যার দিকে আদমদীঘির রহিম উদ্দিন কলেজ মোড়ে ইজিবাইক নিয়ে তিনি যাত্রীর অপেক্ষায় ছিলেন। এ সময় অচেনা তিনজন ব্যক্তি নওগাঁ সদরের ত্রিমোহনী বাজারে যাওয়ার কথা বলে ৩৫০ টাকা ঠিক করে যাত্রীর আসনে বসে পড়েন। এরপর আদমদীঘির ছাতিয়ানগ্রাম ইউনিয়নের অন্তাহার-দুর্গাপুর সড়কের সেতুসংলগ্ন পৌঁছালে কৌশলে ইজিবাইক থামিয়ে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে প্রথমে তাঁকে বেঁধে মুখে গামছা পেঁচিয়ে ধানখেতে ফেলে রাখে ছিনতাইকারীরা। এরপর একজন ধারালো অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে রাখে এবং অন্যরা ইজিবাইক ছিনতাই করে পালিয়ে যায়।
রাত ১০টার দিকে হামাগুড়ি দিয়ে রাস্তায় ওঠার পর চিৎকার দিলে আশপাশের লোকজন এসে উদ্ধার করে আদমদীঘি থানায় পৌঁছে দেন। পরে ঘটনা বলার পর ইজিবাইক উদ্ধারে পুলিশ অভিযানে নামে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, ইজিবাইকচালক ভাসানী পুলিশকে জানিয়েছিলেন তাঁর কাছে ফোন না থাকায় ছিনতাইকারীদের একজনের মুঠোফোন থেকে তিনি একবার বাড়িতে তাঁর এক আত্মীয়র সঙ্গে কথা বলেছিলেন। সেই ফোন কলের সূত্র ধরে প্রযুক্তির সহায়তায় রোববার প্রথমে বিদ্যুৎ হোসেনকে শনাক্ত ও আটক করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বিদ্যুৎ ছিনতাইয়ের কথা স্বীকার করে জানান, ইজিবাইকটি ৪০ হাজার টাকায় খায়রুলের কাছে এবং ব্যাটারি খুলে তা আলী হাসানের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
পরে আলাদা অভিযান চালিয়ে খায়রুল, আলী হাসান এবং খায়রুলের সহযোগী আবদুল মজিদকে আটক করা হয়। ইজিবাইকের চাকা ও ছাউনি খুলে লন্ডভন্ড করে আবদুল মজিদের হেফাজতে রাখা হয়েছিল। পরে মজিদের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাঁকে আটক এবং তাঁর হেফাজত থেকে ইজিবাইকের মালামাল উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় আজ সোমবার আদমদীঘি থানায় চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলী হায়দার চৌধুরী আরও বলেন, ছিনতাইকারী দলের মূল হোতা বিদ্যুৎ হোসেন স্বীকার করেছেন, দীর্ঘদিন ধরে ইজিবাইক ছিনতাইয়ের সঙ্গে তিনি জড়িত। আবদুল মজিদের মাধ্যমে ছিনতাই করা ইজিবাইক বিক্রি করতেন তিনি। ছিনতাই করা ইজিবাইক কেউ যাতে চিনতে না পারে, এ জন্য চাকা, ব্যাটারি ও অন্যান্য পার্টস খুলে আলাদাভাবে বিক্রি করতেন।