পীরগঞ্জের হিন্দুপাড়ায় গোখাদ্যের চরম সংকট

রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার হিন্দুপাড়ায় উত্তেজিত জনতার দেওয়া আগুনে খড়ের গাদা পুড়ে গেছে। এতে গরুর খাবারের সংকটে দেখা দিয়েছে
ছবি: প্রথম আলো

রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার মাঝিপাড়া গ্রামের বড়করিমপুর এলাকার প্রতিটি বাড়িতে গরু পালন করা হয়। অনেকের গরু লুট হয়েছে, আবার গরুর খাবার হিসেবে মজুত খড় আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে উত্তেজিত জনতা। গবাদিপশু নিয়ে বেশ বিপদেই আছেন ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগে উত্তেজিত জনতার আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামটির বাসিন্দারা।

বড়করিমপুরের নিরঞ্জন রায় বলেন, এখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের ৬৭টি পরিবারের বাস। কম-বেশি তারা সবাই গরিব। মাছ ধরে ও মাছের ব্যবসা করে তাদের সংসার চলে।

সংসারের সচ্ছলতা ফেরাতে প্রতিটি বাড়িতে গাভি ও ছাগল পালন করা হয়। গ্রামে কমপক্ষে ১০০টি গরু ও ৪০টি ছাগল ছিল। উত্তেজিত জনতার দেওয়া আগুনে পুড়ে মারা গেছে সুমতি রানীর বিদেশি জাতের একটি গাভি। এ সময় উত্তেজিত জনতা ২৫টি গরু ও ১০টি ছাগল নিয়ে গেছে। ঘটনার তিন দিন পর একটি বেসরকারি সংস্থা ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ৩০টি গরু বিতরণ করে। গরুর প্রধান খাদ্য খড়। পুরো বছরে গরুকে খাওয়ানোর জন্য বাড়ির উঠানে খড় গাদা করে রাখা ছিল। সব খড়ের গাদা আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন গরুকে খাওয়ানোর কোনো খড় নেই। এ সময় মাঠে ঘাসও নেই।

কল্পনা রানী বলেন, ‘আমার দুটি গরু আছে। খড়ের গাদা আগুন দিয়ে পোড়ায় দিছে। এখন গরুকে খাওয়ানোর খড় নাই। স্বামী কাজে যেতে পারছে না। পুলিশ অনেক লোককে ধরছে। ভয়ে আমরা আশপাশের বাজারে যেতে পারছি না। খড়ের অভাবে গরু নিয়ে খুব বিপদে পড়েছি।’

গোয়ালে থাকা দুটি গরু দেখিয়ে শ্যামলী রানী (৪৪) বলেন, ‘ওরা (উত্তেজিত জনতা) গ্রামোত ঢুকিয়া আগোত খড়ের পালাত আগুন নাগাইছে। বাড়িঘর ভাঙচুর করছে, পুড়ি দেছে। মানুষ পর দিন থাকি গ্রামোত খুব আইসোছে। মিথ্যা কথা কবার নেই, সাহায্য–সহযোগিতা পাওছি। পাঁচ দিন থাকি গরু গুলাক পানি আর গুঁড়া খিলিয়া বাঁচে থুইচি।’

নতুন টিনে স্বামীর সঙ্গে চালা ঘিরছিলেন মিনতি রানী (৪২)। তিনি বলেন, ‘পাঁচ দিন থাকি বাড়ির বাইরোত ভয়ে বের হই নাই। গরুর খড় সউগ আগুনে পুড়ি ছাই হইছে। এ্যালা গরুর খাবার নাই। খড় ঘাস ভুসির জন্য যখন অবলা গরুগুলা ডাকোছে, তখন বুকটা ফাটি যাওচে। সোবায়ও হামাক খাবার, কাপড় চোপড় দেওছে। কিন্তু হামরা যে গরুগুলাক খাবার দিবার পাওছি না।’

সহদেব চন্দ্র রায়ের (৩৭) সচ্ছল পরিবার। প্রতিবছর গরু পালন করে লাভবান হন তিনি। তাঁর খামারে পাঁচটি গরু আছে। তিনি আজ শনিবার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘অবলা গরুগুলা নিয়া খুব কষ্টোত পড়ছি। পোড়া যাওয়া খড়ের পুজের (গাদা) আধা পোড়া খড় উপায় না পায়া গরুক খিলাছু। পেট ফিকি একটা গরু কাইল (শুক্রবার) মরি গেইছে।

একটা খুব অসুস্থ হয়া পড়ছে। ডাক্তার কইছে, পোড়া খড় খায়া গরু মরি গেইছে। হামার ঘরের সউগ জিনিস লুট করি নিয়া গেইছে। গরুগুলা আছে। এ্যালা যদি গরুগুলোক বাঁচার না পাও, তা হইলে মুই কী করি খাইম। বাজারোত গরুর খাবার আইনবার যাওয়ার সাহস পাওচি না।’

এ সময় প্রতিবেশী জগদীশ চন্দ্র, হরিদাস চন্দ্র, ননী গোপাল, অর্জুন চন্দ্র ও পণ্ডিত রায় বলেন, খড় না থাকায় তাঁরা গরু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন।

পীরগঞ্জ উপজেলা পশুসম্পদ কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম বলেন, ‘বড়করিমপুরে সব পুড়ে যাওয়ায় গোখাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে অনেকেই খাবার ও টাকা দিচ্ছে, কিন্তু খড় না থাকায় গরু নিয়ে তাঁরা বিপাকে পড়েছেন।’ তিনি জানান, আগুনে পুড়ে বড়করিমপুরে দুটি গরু মারা গেছে। গতকাল পোড়া খড় খাওয়ানোর কারণে বিষক্রিয়ায় সেখানে আরও একটি গরুর মৃত্যু হয়েছে।