পোড়া মুখ নিয়ে ঘরে বাইরে মহসিনার যুদ্ধ

‘মাইয়া মানুষের তেজ থাকতে নাই’, ‘দাসী–বান্দির মতো পড়ে থাক’ এমন নানান কথা শুনতে হয়েছে নারায়ণগঞ্জের অ্যাসিডদগ্ধ মহসিনাকে।

নিজের ঘরে বসে সেলাই মেশিনে কাজ করেন মহসিনা বেগম। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের ব্রাহ্মণদী গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

হার না–মানা এক জীবনের গল্পে আর হতাশার কথা বলতে ভালো লাগে না মহসিনা বেগমের (৫২)। আলাপের একপর্যায়ে বললেন, ‘না খাইয়া মরি মরি অবস্থা ছিল। তখনো কাজ করতে গেলে শুনতে হইছে নিজের দোষেই নাকি মুখ পুড়ছে। মাইয়া মানুষের নাকি ত্যাজ থাকতে নাই। দাসী–বান্দির মতো নাকি স্বামীর ঘরে পইড়া থাকতে হয়। আমি ওই সব বিশ্বাস করি নাই। বাঁচতে হয় সম্মান নিয়া।’

নিজের আয়ে তৈরি ছোট্ট দোচালা ঘরে সেলাই মেশিনে কাজ করতে করতেই জীবনের গল্প বলছিলেন মহসিনা বেগম (৫২)। মেশিনের সুই–সুতার এফোঁড়-ওফোঁড় করা ওঠানামায় তখন মহসিনার হাতে সেলাই হচ্ছিল আরও একটি নতুন জামা। পায়ে মেশিন চেপে মহসিনা যখন কথা বলছিলেন, তখন তাঁর চোখ নিখুঁত সেলাইয়ে। দুঃখের দিনগুলোর কথা বলতে গিয়ে সে চোখ অশ্রুতে ভরে ওঠে। ওড়নায় চোখ মুছে আবারও লড়াকু জীবনের গল্প বলতে শুরু করেন মহসিনা।

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের ব্রাহ্মণদী ইউনিয়নে মহসিনার বাবার বাড়ি। মাত্র ১৫ বছর বয়সে একই গ্রামের মো. জাকারিয়াকে বিয়ে করেন তিনি। এরপর শুরু হয় আরেক বিভীষিকার জীবন। যৌতুকের জন্য দিনরাত স্বামীর নির্যাতনের শিকার হন। বিয়ের বছরেই স্বামীর ঘর ছাড়েন। আশ্রয় নেন বাবার বাড়িতে। সেখানেই একদিন ঘুমের মধ্যে স্বামীর ছোড়া অ্যাসিডে ঝলসে যায় মহসিনার মুখ।

আবারও বিয়ে হয় মহসিনার। কিন্তু সাত বছরের সে সংসারেও সুখ আসেনি। ছোট দুই মেয়েকে রেখে আরেকটি বিয়ে করে আলাদা ঘর বাঁধেন মহসিনার দ্বিতীয় স্বামী। আবারও বাবার বাড়িতে ফিরে আসেন তিনি। নিজেই শুরু করেন ভাগ্য গড়ার কাজ।

অত্যাচার নির্যাতনের স্মৃতি আর অ্যাসিডে ঝলসানো মুখ নিয়ে সেলাই মেশিনের কাজ করে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন মহসিনা। আশপাশের মানুষের কাছে হয়ে উঠেছেন লড়াকু এক জীবনের উদাহরণ। ‘নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুনে উদ্যমে জীবন শুরু করেছেন যে নারী’ ক্যাটাগরিতে ঢাকা বিভাগের শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।

মহসিনার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক সময় সেলাইয়ের কাজ শেখেন। নিজেই জামা বানিয়ে বিক্রি শুরু করেন। সেই আয়ে দুই সন্তানের পড়াশোনা হয়, নিজের ছোট ঘর আর আসবাবপত্রও হয়। অ্যাসিডে ঝলসানোর পর নিজের চিকিৎসা করতে না পারা মহসিনা বছর দশেক আগে নিজের চিকিৎসাও করিয়েছেন ঢাকার একটি হাসপাতালে।

মহসিনা বলেন, ‘পোড়া মুখ নিয়া সমাজে বাঁইচা থাকাটা সহজ না। নারীরা আগাইতে চাইলে সমাজ পেছন থেইকা টাইনা ধরে। পদে পদে যুদ্ধ কইরা আগাইতে হয়। এই যুদ্ধটা নিজের একার। ঘরে-বাইরে যুদ্ধ কইরাই বাঁইচা আছি।’