প্রতিদিন উদ্ধার হচ্ছে মাদক, তবু মাদকের বিস্তার বাড়ছেই

প্রায় প্রতিদিনই জেলার বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হচ্ছেন মাদক কারবারি ও মাদকসেবীরা। উদ্ধার হচ্ছে মাদকদ্রব্যও। তারপরও টাঙ্গাইলে ঠেকানো যাচ্ছে না মাদকের বিস্তার। জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচিত হচ্ছে প্রতি মাসেই।

জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় উপস্থাপিত অপরাধের চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ২৫ মাসে জেলায় বিভিন্ন অপরাধে মোট মামলা হয়েছে ৩ হাজার ৮২১টি। এর মধ্যে ১ হাজার ২০টি মামলাই মাদকের, যা মোট মামলার ২৬ দশমিক ৬৯ ভাগ।

টাঙ্গাইল জেলা কারাগারের জেল সুপার আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, এই কারাগারে ১ হাজার ৫২৪ জন বন্দী রয়েছেন। যাঁদের বড় একটি অংশ মাদক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে এসেছেন। ১৫ এপ্রিল থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ১০ দিনে ৩৩৩ জন আসামি কারাগারে প্রবেশ করেছেন। যাঁদের মধ্যে ১১৯ জনই মাদক মামলার আসামি। যা মোট আসামির ৩৫ দশমিক ৭৪ ভাগ।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা জানান, টাঙ্গাইলের সঙ্গে দেশের উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর খুব ভালো সড়ক ও রেল যোগাযোগব্যবস্থা রয়েছে। ওই সব এলাকা থেকে ফেনসিডিল, হেরোইনসহ নিষিদ্ধ মাদক খুব সহজে জেলায় পৌঁছতে পারে। এ ছাড়া কক্সবাজার এলাকা থেকে ইয়াবার চালান আসছে প্রতিনিয়ত। গত কয়েক বছরে জেলার প্রতিটি উপজেলা, এমনকি গ্রাম পর্যায়ে ইয়াবার বিস্তার ঘটেছে। প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় চলছে এসব মাদক ব্যবসা।
একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, অনেক মাদকসেবী মাদক গ্রহণের টাকা সংগ্রহের জন্য জড়িয়ে পড়ছেন মাদক ব্যবসায়। এ ছাড়া অন্য যেকোনো ব্যবসার চেয়ে মাদক কারবার অনেক লাভজনক হওয়ায় এবং রাতারাতি অনেক টাকা আয়ের সুযোগ থাকায় অনেকেই এ কারবারে জড়িয়ে পড়ছেন। তাই একবার কেউ গ্রেপ্তার হলে জামিন মুক্ত হয়ে আবার মাদক কারাবারে জড়িয়ে পড়ছেন। অধিকাংশ মাদকসেবী মাদকের টাকা সংগ্রহ করতে গিয়ে ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন।

জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির প্রতি মাসের সভাতেই বিভিন্ন উপজেলা চেয়ারম্যানরা তাঁদের উপজেলায় মাদকের বিস্তার নিয়ে কথা বলেন। ওই কমিটির সদস্য টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবের সভাপতি জাফর আহমেদ জানান, মাদকের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযানের পাশাপাশি এর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার বিষয়েও সভায় আলোচনা করা হয়।

একাধিক মাদক কারবারি জানান, তাঁরা গ্রেপ্তার হওয়ার পর এই কারবার থেকে ফিরে আসতে চাইলেও ফিরতে পারেননি। মাদক কারবার না করলেও পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁদের নানাভাবে হয়রানি করে। বাধ্য হয়ে আবার যেতে হয় মাদক কারবারে।

সরকারি এম এম আলী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শামসুল হুদা জানান, শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না। মাদকমুক্ত সমাজ গঠনের জন্য প্রতিটি পরিবার থেকে কাজ শুরু করতে হবে। অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। তাঁদের সন্তানেরা যাতে মাদকের সংস্পর্শে যেতে না পারে, সেটিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ও প্রবীণ গণসংগীতশিল্পী এলেন মল্লিক জানান, সুষ্ঠু সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়াচর্চার অভাবে তরুণ প্রজন্ম মাদকের দিকে ঝুঁকছে। তাদের মাদকের হাত থেকে রক্ষা করতে পাড়ায় পাড়ায় ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক চর্চার কার্যক্রম জোরদার করা প্রয়োজন।

টাঙ্গাইল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. শাহনেওয়াজ জানান, শুধু অভিযান চালিয়ে মাদক উদ্ধার করে মাদক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। তাই তাঁদের অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য স্কুল পর্যায়ে সচেতনতামূলক বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে মানুষকে সম্পৃক্ত করে মাদকবিরোধী কর্মকাণ্ড করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার জানান, মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সবাইকে মাদক সম্পর্কে সচেতন হয়ে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। তাহলে মাদক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে।