প্রতিবাদের মধ্যেই ফেনীতে সংঘর্ষ

নোয়াখালী, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ জানিয়েছেন হিন্দু সম্প্রদায়সহ সচেতন নাগরিকেরা।

বিভিন্ন স্থানে মণ্ডপ-মন্দিরে হামলার প্রতিবাদে আয়োজিত সমাবেশে বক্তব্য দেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত। গতকাল চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লায়।
ছবি: প্রথম আলো

মন্দির ও পূজামণ্ডপে হামলার প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ–প্রতিবাদের মধ্যেই ফেনী শহরে নতুন করে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল শনিবার বিকেলে জেলা পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের মানববন্ধন চলাকালে ঢিল ছোড়াকে কেন্দ্র করে সেখানে সংঘর্ষ হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাসহ আহত হয়েছেন অন্তত ১৫ জন। এ সময় ফেনী শহরের কয়েকটি দোকানে ভাঙচুর করা হয়। আগুন দেওয়া হয় একটি গাড়িতে। হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি আশ্রম ও মন্দিরে হামলা চালানো হয়।

গতকাল শনিবার বিকেল ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত ফেনী শহরের ট্রাংক রোড, ফেনী বাজার ও শহরতলির কালীপাল এলাকায় এসব ঘটনা ঘটে। জেলা পুলিশ সুপার খোন্দকার নুরুন্নবী জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বেশ কয়েকটি ফাঁকা গুলি ছুড়তে হয়েছে। শহরে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। ঘটনার সময় ইটপাটকেলের আঘাতে ফেনী মডেল থানার ওসিসহ ১৫-১৬ জন আহত হয়েছেন।

এদিকে নোয়াখালীর চৌমুহনীতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা। চট্টগ্রামে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ গতকাল দিনভর মিছিল, বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছে। এ ছাড়া নগরে আধা বেলা হরতাল কর্মসূচি পালিত হয়। দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত

বলেন, দুর্গাপূজায় দেশের বিভিন্ন স্থানে তিন দিনে ৭০টি পূজামণ্ডপে হামলা-ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এর বাইরে ৩০টি বাড়ি এবং ৫০টি দোকানে ভাঙচুর ও লুটপাট হয়।

ফেনীতে দফায় দফায় সংঘর্ষ

পুলিশ সূত্র ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল বিকেলে শহরের ট্রাংক রোডে কালীমন্দিরের সামনে জেলা পূজা উদ্‌যাপন পরিষদ মানববন্ধন কর্মসূচি শুরু করে। এ সময় পাশের বড় মসজিদ (ফেনী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ) থেকে আসরের নামাজ শেষে বের হওয়া কিছু লোকের সঙ্গে মানববন্ধনকারীদের সংঘর্ষ বাধে। একপর্যায়ে পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের লোকজন বাঁশপাড়ার দিকে চলে যান। কিছুক্ষণ পর পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের লোকজনের সঙ্গে যোগ দেন ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতা–কর্মী। এরপর দুপক্ষের মধ্যে আবার সংঘর্ষ বাধে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ দুপক্ষকে লাঠিপেটা করে। এ ছাড়া কাঁদানে গ্যাসের শেল ও বেশ কয়েকটি শটগানের গুলি ছোড়ে। এ সময় দফায় পাল্টাপাল্টি ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এ সময় ইটের আঘাতে ফেনী মডেল থানার ওসি মো. নিজাম উদ্দিনসহ কয়েকজন আহত হন।

পুলিশ সূত্র জানায়, ওই ঘটনার রেশ না কাটতেই মাগরিবের নামাজ শেষে ফেনী বড় মসজিদের সামনে অবস্থান নেওয়া যুবকদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আবার সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে পুলিশ এসে দুই পক্ষকে সরিয়ে দিলে পরিস্থিতি শান্ত হয়। এরপর শহরের বিভিন্ন এলাকায় আরও কিছু বিক্ষিপ্ত হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে রাত ৯টার পর শহরের তাকিয়া রোড ও বড় বাজারের ভেতরের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনের মালিকানাধীন কয়েকটি দোকানে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া বড় বাজারের ভেতরে একটি কালীমন্দির এবং শহরতলির কালীপাল গাজীগঞ্জ আশ্রমে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।

ফেনী মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনির হোসেন জানান, গাজীগঞ্জ আশ্রমের তেমন ক্ষতি হয়নি। তবে আশ্রমের সামনে একটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া বড় বাজারে চার-পাঁচটি দোকানে হামলা–ভাঙচুর হয়েছে।

নোয়াখালীর মন্দিরে ক্ষতচিহ্ন, সড়ক অবরোধ

নোয়াখালীর চৌমুহনীর ব্যাংক রোডে রাধামাধব জিউর মন্দিরে ঢোকার মুখেই ভাঙা ফটকের আশপাশে ভাঙা কাচ, হামলা-ভাঙচুরে ক্ষতিগ্রস্ত মন্দিরের জিনিসপত্র পড়ে থাকতে দেখা গেছে।

গতকাল বেলা পৌনে তিনটার দিকে মন্দির পরিদর্শনে এলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা, প্রশাসনের কর্মকর্তা ও গণমাধ্যমকর্মীদের দেখে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। তাঁরা আগের দিন প্রশাসনের ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে নানা স্লোগান দিতে থাকেন এবং গণমাধ্যমকর্মীদের মন্দিরে ঢুকতে বাধা দেন।

বাধা পেরিয়ে মন্দিরের নিচতলা ও দ্বিতীয় তলায় গিয়ে দেখা যায়, পূজা উপলক্ষে তৈরি করা প্যান্ডেলসহ সবকিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় তলার প্রতিমার কক্ষসহ প্রতিটি কক্ষে হামলা-ভাঙচুরের চিহ্ন। ভাঙাচোরা আসবাবগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এরপর বেগমগঞ্জের চৌমুহনীর দক্ষিণ বাজারের রামঠাকুরের আশ্রমে গিয়ে দেখা যায়, সেখানেও আশ্রমের প্রতিটি কক্ষ হামলা-ভাঙচুর করা হয়েছে। আশ্রমের সামনে পড়ে আছে পুড়ে যাওয়া দুটি ব্যক্তিগত গাড়ি।

কুমিল্লার ঘটনার জের ধরে চৌমুহনীতে গত শুক্রবার হামলা-ভাঙচুরের পর গতকাল মন্দিরসংলগ্ন পুকুর থেকে এক ইসকন–ভক্তের লাশ উদ্ধার করা হয়। তাঁর নাম প্রান্ত চন্দ্র দাস (২৬)। গতকাল সকাল ছয়টার দিকে মন্দিরসংলগ্ন পুকুরে প্রান্ত চন্দ্র দাসের লাশ ভেসে ওঠে বলে জানান ইসকন মন্দিরের সহসভাপতি হরিপ্রেম প্রসাদ দাস।

ইসকন–ভক্তের লাশ উদ্ধারের পর চৌমুহনীতে উত্তেজনা বেড়ে যায়। ইসকন অনুসারীসহ ক্ষুব্ধ হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন সকালে লাশ নিয়ে শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। তাঁরা এ সময় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ফেনী-নোয়াখালী সড়কে অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করেন। কিছু সময় পর লাশ মন্দিরে নিয়ে গেলেও অবরোধ চলে বেলা তিনটা পর্যন্ত। এ সময় সড়কটিতে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে।

সংক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজের ব্যানারে গতকাল বিকেলে নোয়াখালী শহরের টাউন হল মোড়ের প্রধান সড়কে কয়েক শ মানুষ প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন করেন। সমাবেশে বক্তারা অবিলম্বে এ হামলার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও বিচার দাবি করেন। সমাবেশে বক্তৃতা করেন নোয়াখালী নাগরিক অধিকার মোর্চার যুগ্ম আহ্বায়ক মোল্লা হাবিবুর রাসুল, জাসদের সভাপতি আজিজুল হক বকশী, নোয়াখালী নাগরিক অধিকার মোর্চার যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল আলম প্রমুখ।

এদিকে বেগমগঞ্জ থানার ওসি মুহাম্মদ কামরুজ্জামান জানান, হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় পুলিশ ৪৭ জনকে আটক করেছে।

ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। শুক্রবার রাতে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তারিকুল আলমকে প্রধান করে তিন সদস্যের ওই কমিটি গঠন করা হয়। এ ছাড়া মন্দির ও দোকানপাটের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালককে আহ্বায়ক করে আরেকটি কমিটি করা হয়েছে। উভয় কমিটি এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে বলে জানান জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম খান।

এর আগে গতকাল সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাংসদ আবু সাঈদ আল মাহমুদ, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, অর্থবিষয়ক সম্পাদক সাংসদ ওয়াসিকা আয়েশা খান, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সেলিম মাহমুদ, পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. আনোয়ার হোসেন। সঙ্গে ছিলেন নোয়াখালী-৩ (বেগমগঞ্জ) আসনের সাংসদ মামুনুর রশিদ, জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক এ এইচ এম খায়রুল আনম চৌধুরী।

জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সদস্যসচিব পাপ্পু সাহা বলেন, ‘শুক্রবার বিক্ষোভ মিছিল থেকে চালানো তাণ্ডবে চৌমুহনী শহরের কমপক্ষে ৩০টি দোকান, ৫০টি বাসাবাড়ি ও ১২টি মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হামলা-ভাঙচুরের বিষয়ে তাঁরা নিজেরা বাদী হয়ে কোনো মামলা করবেন না।’

হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির, দোকানপাট ও বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুরের বিষয়ে চৌমুহনী বড় মসজিদের খতিব মাওলানা শফিউল্যাহ বলেন, ‘যে ঘটনা ঘটেছে, তা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। ইসলাম এ ধরনের ঘটনা কখনোই সমর্থন করে না। প্রশাসনের উচিত দোষীদের আইনের আওতায় আনা।’

প্রসঙ্গত, কুমিল্লার ঘটনার জের ধরে শুক্রবার চৌমুহনীতে হিন্দুদের দোকানপাট ও মন্দির এবং বাসাবাড়িতে হামলা-ভাঙচুর চালানো হয়।

চট্টগ্রামে দিনভর বিক্ষোভ

মঠ, মন্দিরে হামলা, প্রতিমা ভাঙচুর ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবাদে গতকাল দিনভর চট্টগ্রাম ছিল প্রতিবাদমুখর। গতকাল চট্টগ্রামে আধা বেলার হরতাল পালিত হয়েছে। সকাল থেকে নগরের আন্দরকিল্লা এলাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল করেছে বিভিন্ন সংগঠন। পরে সারা দেশে গণ–অনশন ও বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দেওয়া হয়।

চট্টগ্রামের প্রধান পূজামণ্ডপ জে এম সেন হলে গত শুক্রবার দুপুরে হামলার ঘটনার প্রতিবাদে গতকাল নগরে দুপুর ১২টা পর্যন্ত হরতাল কর্মসূচি পালনের ডাক দিয়েছিল হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। কর্মসূচি চলাকালে নগরের আন্দরকিল্লা ও আশপাশের এলাকায় গতকাল যানবাহন চলেনি।

আন্দরকিল্লায় বিক্ষোভ সমাবেশ বক্তব্য দেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত। তিনি হামলার ঘটনার জন্য প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তাকে দায়ী করেন।

সমাবেশ শেষে মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি জামালখান প্রেসক্লাব চত্বরে গিয়ে পুনরায় সমাবেশ করে। এ সময় ওই সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে। সেখানে রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘সাম্প্রদায়িক হামলাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমরা মনে করি এবং বিশ্বাস করি সবটাই পরিকল্পিত। এসব ঘটনার প্রতিবাদে আগামী শনিবার ৬ ঘণ্টার অনশন ও গণ–অবস্থান কর্মসূচি পালিত হবে। চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা মোড়ে এবং ঢাকার শাহবাগ চত্বরে এই কর্মসূচি পালিত হবে।’

এদিকে ঘটনার প্রতিবাদে বিকেলে নগরের প্রেসক্লাব চত্বরে প্রতিবাদ সমাবেশ ও মিছিল করেছে জেলা ও মহানগর পূজা উদ্‌যাপন পরিষদ। জে এম সেন হলে হামলার ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় মামলা হয়েছে। এই ঘটনায় ৮৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে থানার ওসি নেজাম উদ্দীন জানান।

সিরাজদিখানে প্রতিমা ভাঙচুর

মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে একটি মন্দিরের ছয়টি প্রতিমা ভাঙচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। শুক্রবার দিবাগত মধ্যরাতে উপজেলার রশুনিয়া ইউনিয়নের দানিয়াপাড়া শ্মশানঘাট কালীমন্দিরে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর সনাতন ধর্মাবলম্বীসহ এলাকাবাসী ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

সিরাজদিখান থানার ওসি মোহাম্মদ বোরহান উদ্দিন জানান, মন্দিরের ভেতরে ঢুকে দুর্বৃত্তরা কয়েকটি মূর্তির হাত–পা ভেঙেছে।