প্রতি কেজি চিনিতে পাইকারের লাভ ১২ টাকা!

চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের মীর আহমেদ সওদাগর ট্রেডার্স গত মঙ্গলবার ৯টি প্রতিষ্ঠানের কাছে ২৪০ মেট্রিক টন চিনি বিক্রি করে। প্রতি কেজি চিনি তারা কেনে ৪৬ টাকায়। বিক্রি করে ৫৮ টাকায় (পাইকারি দর)। সে হিসাবে কেজিতে ১২ টাকা লাভে শুধু এক দিনেই প্রতিষ্ঠানটি মুনাফা করেছে ২৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা। গতকাল বুধবার খাতুনগঞ্জে মীর গ্রুপের কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে তাদের কাগজপত্র পর্যালোচনা করে এই চিত্র দেখতে পান ভ্রাম্যমাণ আদালত।
গত এক সপ্তাহে এই প্রতিষ্ঠানটি পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি চিনির দাম গড়ে প্রায় সাড়ে ৪ টাকা বেশি দামে বিক্রি করেছে। চিনির পাইকারি বাজারে কারসাজি করায় প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুস সালাম ও বিক্রয় ব্যবস্থাপক জানে আলমকে ২০ লাখ টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। প্রতিষ্ঠানটির খাতুনগঞ্জের কার্যালয়টি বন্ধ করে দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযানে নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিলুর রহমান। অভিযানে সহায়তা দেয় র্যা ব।
ভ্রাম্যমাণ আদালত বলেন, এস আলম সুগার রিফাইনারির কাছ থেকে চিনি কেনে মীর আহমেদ সওদাগর ট্রেডার্স। সেই চিনি চড়া দামে অন্য পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে তারা। কয়েক হাত ঘুরে ক্রেতার হাতে যখন সেই চিনি পৌঁছায়, তখন দাম আরও বেড়ে যায়। গতকাল চট্টগ্রামের খুচরা বাজারে প্রতি কেজি খোলা চিনির দাম ছিল ৬৫ টাকা।
জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিলুর রহমান বলেন, মীর আহমেদ সওদাগর ট্রেডার্সের কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখা গেছে, গত এক সপ্তাহে প্রতিষ্ঠানটি দিনে গড়ে এক কোটি টাকার মতো লাভ করেছে। সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে ব্যবসা করায় প্রতিষ্ঠানটিকে ২০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
ভ্রাম্যমাণ আদালত মীর আহমেদ সওদাগর ট্রেডার্সের বিক্রয় ব্যবস্থাপক জানে আলম ও আরও দুই কর্মচারীকে আটক করে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়ে যান। ঘণ্টাখানেক পর প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুস সালামকেও সেখানে ডেকে নেওয়া হয়। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালত আবদুস সালামকে ১০ লাখ এবং জানে আলমকে ১০ লাখ টাকা করে মোট ২০ লাখ টাকা জরিমানা করেন। আটক করা দুই কর্মচারীকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিলুর রহমান বলেন, আবদুস সালাম মুচলেকা দিয়েছেন যে তিনি এরপর থেকে কেজিতে ২-১ টাকার বেশি লাভ করবেন না। পাইকারি ব্যবসায়ীরা রোজা শুরুর আগে প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকে বেশি মুনাফা না করার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু অভিযানে দেখা যাচ্ছে, বেশির ভাগই সে প্রতিশ্রুতি রাখছেন না।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে মীর গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুস সালাম সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, ‘দাম নিয়ে একটা ভুল-বোঝাবুঝি হয়েছে। ৪৬ টাকায় চিনি কেনার কথা হয়েছে। কিন্তু এখনো সেটি পাইনি। এর আগে চিনি কিনেছি ৫০ টাকায়, এর সঙ্গে প্রতি কেজিতে ৪ টাকা পরিবহন খরচ আছে। সব মিলিয়ে কেজিতে ৪ টাকার বেশি লাভ হচ্ছে না। এখন থেকে আরও কম দামে চিনি বিক্রি করব।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এস আলম সুপার রিফাইনারির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রচলিত বাজারদর অনুযায়ী মীর আহমেদ সওদাগর ট্রেডার্সের কাছে আমরা চিনি বিক্রি করি। এরপর তাঁরা নিজেদের লাভ ও বাজার বুঝে সেই চিনি পাইকারি দরে বিক্রি করেন। কত লাভে বিক্রি করেন সেটা আমরা তদারক করি না।’
সিন্ডিকেট করে অসাধু ব্যবসায়ীরা চিনিসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে উল্লেখ করে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণ মানুষ এ ধরনের ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি। প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও বড় ব্যবসায়ীরা তা পালন করছেন না। এর কারণ, অপরাধ করেও তাঁরা কোনো শাস্তি পান না। মীর গ্রুপকে যে জরিমানা করা হয়েছে, আশা করি এটার একটা ভালো ফল পাওয়া যাবে।
এদিকে কর্মচারীসহ তিনজনকে আটক করায় গতকাল বেলা দেড়টার দিকে স্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ী খাতুনগঞ্জের সড়কে ঠেলাগাড়ি রেখে যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন। এ সময় কয়েকজন ব্যবসায়ী ও দোকান কর্মচারী অভিযানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেন। অবশ্য দুই কর্মচারীকে ছেড়ে দেওয়ার পর বিকেল সাড়ে চারটার দিকে সড়ক থেকে তাঁরা সরে যান।
অভিযানের বিষয়ে খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ছৈয়দ ছগীর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করে ব্যবসায়ীরা বলেছিলাম দ্রব্যমূল্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, চিনির পাইকারি দামটা একটু বেশিই রেখেছেন সালাম ভাই (মীর গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক)। এটা কিছুটা দোষেরই বলা যায়। যা-ই হোক, ভ্রাম্যমাণ আদালত প্রমাণ সাপেক্ষে তাঁকে জরিমানা করেছেন। আশা করছি, সবাই সতর্ক হবেন।’
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালতের গতকালের অভিযানে বেশি দামে ছোলা বিক্রি করায় মেসার্স মাসুদ ব্রাদার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। প্রতিষ্ঠানটি মান ভেদে প্রতি কেজি ছোলার দাম ৬ থেকে ৭ টাকা করে বেশি নিচ্ছিল। পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি ছোলা তারা বিক্রি করছিল ৭৭ থেকে ৮০ টাকা দরে। খুচরা বাজারে ছোলার দাম মান ভেদে কেজিপ্রতি ৮৫ থেকে ৯৫ টাকা।