প্রথম হামলা ছাত্রলীগের

সংঘর্ষের সময় হেলমেট পরে দুই যুবলীগ নেতার নেতৃত্ব দেওয়ার প্রশংসা করছেন ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা।

হেলমেট পরে সংঘর্ষে নেতৃত্ব দেন খুলনা মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক সফিকুর রহমান
ছবি: সংগৃহীত

খুলনায় গত বৃহস্পতিবার বিএনপির মিছিলে প্রথমে হামলা করেছিল ছাত্রলীগ। সেখান থেকেই দুই পক্ষের সংঘর্ষের সূত্রপাত। যার এক পক্ষে নেতৃত্ব দেন মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক সফিকুর রহমান ওরফে পলাশ ও জেলা যুবলীগের সভাপতি কামরুজ্জামান জামাল। হেলমেট পরে তাঁদের নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে। সংঘর্ষের পর দুজনের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রশংসা করেছেন ছাত্রলীগের অনেক নেতা-কর্মী।

অন্যদিকে সংঘর্ষে বিএনপির অংশে মহানগর যুবদলের সভাপতি মাহবুব হাসান ওরফে পিয়ারু, সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হুদা চৌধুরী ওরফে সাগর ও মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হেলাল আহমেদ ওরফে সুমনকে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়।

সংঘর্ষের বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ ও ছবি পর্যালোচনা এবং ছাত্রলীগ, বিএনপি ও পুলিশের অন্তত ২৫ জনের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। বিএনপির মিছিলে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে প্রথমে হামলার কথা স্বীকারও করেছেন কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী।

প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিরা বলছেন, ঘটনার দিন প্রথম দিকে পুলিশ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেও পেরে ওঠেনি। বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে চারটা থেকে প্রায় সন্ধ্যা সোয়া ছয়টা পর্যন্ত দুই পক্ষের মধ্যে ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। দুই পক্ষের মধ্যে পড়ে আহত হন বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য। পরে পুলিশ বিএনপির নেতা–কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে দিলে ছাত্রলীগ বিএনপির কার্যালয়ের সামনে গিয়ে সমাবেশস্থল ও চেয়ার ভাঙচুর করে।

তবে পুলিশ মামলা করেছে শুধু বিএনপির নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে। মামলায় পুলিশের ওপর হামলা ও সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। খুলনা সদর থানার উপপরিদর্শক বিশ্বজিৎ কুমার বসু বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের ৯২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ৭০০–৮০০ জনকে আসামি করে মামলাটি করেন। জব্দ তালিকায় ২০ টুকরা ভাঙা ইট, ১২টি কাঠের আছাড়ি ও ৫টি লোহার রড দেখানো হয়েছে।

যেভাবে ঘটনার শুরু

খালেদা জিয়াকে নিয়ে কটূক্তির প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করেছিল মহানগর ও জেলা বিএনপি। বৃহস্পতিবার বিকেলে নগরের কেডি ঘোষ সড়কে দলীয় কার্যালয়ের সামনে এ সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করার অভিযোগে বিকেল চারটার দিকে বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করে মহানগর ও জেলা ছাত্রলীগ।

প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিকেল চারটার দিকে ডুমুরিয়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মোল্লা মোশারফ হোসেনের নেতৃত্বে একটি মিছিল হাদিস পার্কের সামনের সড়ক দিয়ে সমাবেশের দিকে যাচ্ছিল। হাদিস পার্কের দক্ষিণ পাশে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে তখন বিক্ষোভ সমাবেশ করছিল ছাত্রলীগ। বিএনপির মিছিলটি হাদিস পার্ক সড়কের মাঝামাঝি যাওয়ার পরপরই ছাত্রলীগের কয়েকজন লাঠি ও ইটপাটকেল নিয়ে হামলা করেন। এ সময় ডুমুরিয়ার আটলিয়া ইউনিয়ন যুবদলের সদস্য ইউসুফ আলীসহ অন্তত ১০ জন আহত হন। ইউসুফের মাথা ফেটে যাওয়ায় পুরো মুখ ও মাথা রক্তাক্ত হয়। তাঁকে ধরাধরি করে বিএনপির সমাবেশস্থলের কাছে নিয়ে গেলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তখন সমাবেশস্থলের একটি অংশ ইট ও লাঠিসোঁটা নিয়ে ছাত্রলীগকে ধাওয়া দেয়।

সংঘর্ষের সময় হেলমেট পরে খুলনা জেলা যুবলীগের সভাপতি কামরুজ্জামান জামাল
ছবি: সংগৃহীত

ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা দলীয় কার্যালয়ে ফিরে বিষয়টি জানান। এরপর সাড়ে চারটার দিকে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ সংঘবদ্ধ হয়ে সদর থানা মোড়ের কাছে অবস্থিত বিএনপির সমাবেশস্থলের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে। পুলিশ তখন পিকচার প্যালেস মোড়ে ব্যারিকেড দিয়ে তাদের থামানোর চেষ্টা করে।

এ খবর বিএনপির সমাবেশস্থলে পৌঁছালে নেতা–কর্মীরা আরও উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তখন তাঁরা লাঠিসোঁটা ও ইটপাটকেল নিয়ে পিকচার প্যালেস মোড়ের দিকে এগিয়ে যান। সদর থানার পুরোনো কার্যালয় ভেঙে ফেলায় সেখানে বেশ ইটপাটকেল ছিল। বিএনপির নেতা–কর্মীরা সেখান থেকে ইট নিয়ে ছাত্রলীগের ওপর হামলা করেন। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে বৃষ্টির মতো ইট নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে।

খুলনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাসান আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির নেতা–কর্মীদের ছোড়া ইটের আঘাতে পুলিশের কয়েকজন সদস্য আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ বিএনপির নেতা–কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে হয়তো ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা বিএনপির কার্যালয়ের সামনে গিয়ে ভাঙচুর করতে পারেন। মামলার বিষয়ে ওসি বলেন, বিএনপির ইটের আঘাতে ১৪ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। এ কারণে বিএনপির নামে মামলা করা হয়েছে।

জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি পারভেজ হাওলাদার বলেন, মারামারি বা হামলা করার কোনো পরিকল্পনাই ছাত্রলীগের ছিল না। তবে বিএনপির হামলার শিকার হয়ে নেতা–কর্মীরা আর নিশ্চুপ থাকতে পারেননি।

কয়েকটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, পুলিশের লাঠিচার্জ ও টিয়ারসেল নিক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে পালাতে থাকেন বিএনপির নেতা–কর্মীরা। কার্যালয়ের সামনের সমাবেশস্থল ফাঁকা হয়ে গেলে ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে সেখানকার মঞ্চ, চেয়ার, টেবিল ভাঙচুর করেন। এ সময় কয়েকজন পুলিশ সদস্যকেও লাঠি দিয়ে চেয়ার ভাঙতে দেখা যায়।

পরে ছাত্রলীগ সেখান থেকে সরে গেলে তালা ভেঙে দলীয় কার্যালয়ে প্রবেশ করে পুলিশ। বিএনপির নেতা–কর্মীরা অভিযোগ করেন, কার্যালয়ে থাকা নেতা–কর্মীদের ব্যাপক মারধর করে মহিলা দলের ১৪ নেতা–কর্মীকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ।

সংঘর্ষে নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়ে মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক সফিকুর রহমান বলেন, ছাত্রলীগের মিছিলে হঠাৎ করে হামলা করে বিএনপি। তাৎক্ষণিক নেতা–কর্মীদের শান্ত করতে তিনি ঘটনাস্থলে যান। ইট থেকে রক্ষা পেতে ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা হেলমেট পরিয়ে দেন।

জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলা যুবলীগের সভাপতি কামরুজ্জামান জামাল বলেন, মিছিল শেষ করে মোটরসাইকেলে দলীয় কার্যালয় থেকে তিনি ফিরছিলেন। হামলার কথা শুনে হেলমেট পরেই সেখানে চলে যান। তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগ-যুবলীগ করেছি, তাই কোনো নেতা–কর্মীর গায়ে আঘাতের কথা শুনলে সহ্য করতে পারি না।’

মহানগর যুবদলের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হুদা চৌধুরী বলেন, প্রথম দফায় বিএনপির মিছিলে হামলার পর ছাত্রলীগ ও যুবলীগ মিলে সমাবেশে হামলা করতে আসে। তখন আর কেউ বসে থাকতে পারেননি। সমাবেশ থেকে সবাই সেদিকে ছুটে গেলেও পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের হামলার কারণে সেদিকে আগানো যায়নি।