ফল ও সবজি চাষে সফল কৃষিবিদ শাকিল

নিজের শসাখেতে কৃষিবিদ শাকিল আহমেদ। গমজানি গ্রাম, দেলদুয়ার, টাঙ্গাইল, ২৭ জানুয়ারি বিকেলে
ছবি: প্রথম আলো

কৃষি বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নেওয়ার পর বন্ধুদের অধিকাংশই নেমেছেন চাকরির খোঁজে। কিন্তু তিনি চাকরির পেছনে না ছুটে চলে আসেন নিজ গ্রামে। আধুনিক পদ্ধতিতে দেশি–বিদেশি সবজি ও ফলের চাষ শুরু করেন। আর এতেই তিনি বাজিমাত করেন, দেখেন সফলতার মুখ।

ফল ও সবজি চাষে সফল হওয়া এই তরুণ হলেন কৃষিবিদ শাকিল আহমেদ। তিনি টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার গমজানি গ্রামের আবদুল করিমের ছেলে। তিনি নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুই বছর আগে কৃষিতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁকে দেখে গ্রামের অনেকেই এখন আধুনিক পদ্ধতিতে ফল ও সবজি চাষে ঝুঁকছেন।

শাকিল আহমেদ বলেন, ২০২০ সালের মার্চে স্নাতক পরীক্ষা শেষ হয়। এরপরই করোনা প্রতিরোধে শুরু হয় বিধিনিষেধ। তিনি গ্রামে চলে আসেন। গ্রামে এসে দেখতে পান চাষিরা সবাই সনাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদ করেন। মাত্রাতিরিক্ত সার, কীটনাশক ব্যবহার করেন। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়, ফলনও কম হয়। এ ছাড়া প্রচলিত ফসল ধান, শর্ষে এগুলো আবাদ করছেন বছরের পর বছর। অথচ এ জমিতে দেশি–বিদেশি নানান সবজি ও ফল আবাদ করে লাভবান হওয়ার সুযোগ আছে। তিনি অনেককে এ বিষয়ে বোঝান, কিন্তু কেউ উৎসাহ দেখাননি।

একপর্যায়ে শাকিল নিজেই পৈতৃক ৪২ শতাংশ জমিতে শুরু করেন কোরিয়ান সবজি ‘স্কোয়াশ’ চাষ। মাত্র তিন মাসেই স্কোয়াশ বিক্রি করে প্রায় ৪০ হাজার টাকা লাভ করেন। পরে ওই জমিতে তরমুজ, শসা ও বাঙ্গি একসঙ্গে আবাদ করেন। আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ করায় খুব ভালো ফলন হয়। ফেসবুকে এ খবর প্রচার করেন তিনি। আশপাশের গ্রাম, এমনকি টাঙ্গাইল শহর থেকেও ক্রেতারা জমিতে এসেই ফল কিনে নেন। পরে তিনি ৮০ হাজার টাকার তরমুজ, ৭৫ হাজার টাকার শসা ও ২০ হাজার টাকার বাঙ্গি বিক্রি করেন। এতে তাঁর উৎসাহ বেড়ে যায়। অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে চাষাবাদ বাড়াতে থাকেন। এখন তিনি ৪২ শতাংশ জমিতে স্কোয়াশ, ৪০ শতাংশ জমিতে ক্যাপসিকাম, ৫০ শতাংশ জমিতে মিশ্র ফল (পেঁপে, তরমুজ ও বিদেশি ফল) এবং ১২০ শতাংশ জমিতে ব্রুকলি রেড ক্যাভেজ, বাঁধাকপি, টমেটো, লাল শাক ও কচু আবাদ করছেন।

এ ছাড়া এক একরের একটি পুকুরে দেশি জাতের মাছ চাষের উদ্যোগ নিয়েছেন।
শাকিল আরও বলেন, চাষাবাদে খরচ কমাতে তিনি মালচিং পদ্ধতি (জমিতে বেড তৈরি করে তা পলিথিনজাতীয় কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা) ব্যবহার করেন। এতে জমিতে আগাছা জন্মায় না। এ ছাড়া পোকামাকড় দমনে সেক্স ফেরোমেন ফাঁদ, জৈবিক বালাইনাশক এবং মাটির স্বাস্থ্যরক্ষায় কেঁচো সার ব্যবহার করেন।

শাকিলের বাবা করিম জানান, শাকিল যখন বিদেশি সবজি, ফল চাষ শুরু করলো, তখন গ্রামের অনেকেই ওকে পাগল বলতেন। তাঁরা বলতেন, বিদেশি ফল, সবজি এ অঞ্চলে হবে না। আর শাকিল এখন বিদেশি ফল, সবজি আবাদ করে ঢাকায় বিক্রি করছে। এগুলো দেখে গ্রামের মানুষের ভুল ভেঙেছে। অনেক কৃষক এখন শাকিলের মতো বিদেশি ফল ও সবজি চাষে যুক্ত হচ্ছেন।

গতকাল বৃহস্পতিবার গমজানি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, শাকিল নিজেই কৃষিশ্রমিকদের সঙ্গে জমিতে কাজ করছেন। তিনি সবুজ ও হলুদ জাতের স্কোয়াশ তোলা শেষ করে ছুটছেন শসাখেতের দিকে। সেখানে বাবাকে সঙ্গে নিয়ে শসা তোলা শুরু করেন। এ সময় শাকিল বলেন, এ মৌসুমে ছয় লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। আশা করছেন, ১০ লাখ টাকার ওপর ফসল বিক্রি করতে পারবেন।

ওই গ্রামেই কথা হয় কৃষক সেলিম আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, আগে শুধু জমিতে ধান উৎপাদন করতেন। শাকিলকে দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি দেড় বিঘা জমিতে শসা চাষ করেছেন। মাহমুদপুর গ্রামের নোমান মিয়া বলেন, তিনি এবার তাঁর জমিতে শসা ও স্কোয়াশ চাষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

শাকিলের এই আধুনিক চাষাবাদ দেখতে বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে এসেছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান নামের একজন কৃষিবিদ। ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করে ঢাকায় চাকরি করছেন তিনি। এখন তিনি চাষাবাদের পরিকল্পনা করছেন। তিনি বলেন, ‘শাকিলের সাফল্যের কথা যতটা শুনেছিলাম, এখন এসে দেখলাম তাঁর সাফল্য আরও অনেক বেশি।’


শাকিল বলেন, কৃষকেরা যাতে তাঁদের উৎপাদিত ফসল সহজেই বাজারজাত করতে পারেন এজন্য তিনি ফার্মনেট ডট এশিয়া নামে একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম শুরু করেছেন। এর মাধ্যমে প্রান্তিক কৃষকেরা ভোক্তাদের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত হতে পারবেন। এতে কৃষক এবং ভোক্তা উভয়ই লাভবান হবেন। কৃষি এ দেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি। তাই তিনি নিজের একাডেমিক শিক্ষাকে মাঠপর্যায়ে কাজে লাগিয়ে কৃষির উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে চান।

দেলদুয়ার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সোহেব মাহমুদ বলেন, ‘আমি শাকিলের কৃষি প্রকল্পগুলো কয়েকবার পরিদর্শন করেছি। তাঁর এসব উদ্যোগের পাশে সব সময় কৃষি অফিস থাকবে। তাঁর এমন উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়।’