ফাঁদে আটকা মেছো বাঘ ফিরে গেল চারটি বাচ্চা নিয়ে

খাঁচায় আটক বাচ্চাসহ মা মেছো বাঘ। গত মঙ্গলবার সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে
ছবি: সংগৃহীত

লোহার তৈরি খাঁচার ফাঁদে ধরা পড়ে মেছো বাঘটি। খাঁচার মালিক বন বিভাগকে ‘বাঘ’ ধরার খবর দেন। বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের একটি দল রওনা দিল বাঘ উদ্ধারে। পথেই খবর মিলল, বাঘটি খাঁচাতেই দুটি বাচ্চা প্রসব করেছে। ঘটনাস্থলে যেতে যেতে আরও দুটি। আশপাশে ঘুরছে পুরুষ বাঘটিও।

বাঘ দেখতে খাঁচা ঘিরে বিপুলসংখ্যক মানুষের ভিড়। এই ভিড়কে উপেক্ষা করেই বাচ্চাগুলোকে দুধ পান করায় বিপন্ন মা। স্থানীয় লোকদের বোঝানো হলো, মেছো বাঘ শত্রু নয়, বরং প্রাণীটি জলাভূমির পোকামাকড় খেয়ে কৃষকের উপকার করে। এরপর সবার সামনেই খাঁচা খুলে দেওয়া হলো। মেছো বাঘটি ছুটে গেল ঝোপে। সন্ধ্যা হলে বুনোবাসাতে নিয়ে গেল বাচ্চাগুলোকেও। ঘটনাটি সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে লামা টোকের বাজারের দোড়গোড়ীয়া গ্রামের।

বন অধিদপ্তরের বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত মঙ্গলবার মো. ইউসুফ মিয়া নামের এক ব্যক্তি বেলা পৌনে ১১টার দিকে মুঠোফোনে বন বিভাগকে জানান, তাঁদের লোহার খাঁচায় একটি বাঘ ধরা পড়েছে। তাঁরা বাঘটিকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে বলেন। বাঘটি ধরা পড়ে সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার দোড়গোড়ীয়া গ্রামে। খবর জানার পরপরই বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা মির্জা মেহেদী সরোয়ারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি উদ্ধারকারী দল গঠন করে দেন। অন্য সদস্যরা হলেন ফরেস্টার মো. মিজানুর রহমান, বনপ্রহরী মো. সাদেকুর রহমান, জুনিয়র ওয়াইল্ডলাইফ স্কাউট মো. শাহীন আলম ও গাড়িচালক টিপলু দেব। ওই দিন দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মেছো বাঘটি উদ্ধারের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় দলটি। বেলা দুইটার দিকে মো. ইউসুফ মিয়া উদ্ধারকারী দলকে জানান, বাঘটি খাঁচার মধ্যেই দুটি বাচ্চা প্রসব করেছে। অপর দিকে পুরুষ বাঘটি খাঁচার আশপাশে ঘুরছে।

একপর্যায়ে বাচ্চাসহ মেছো বাঘটিকে ঘটনাস্থলের পাশের বাঁশঝাড়ে অবমুক্ত করতে সবাই একমত হন। উৎসুক জনগণকে নির্দিষ্ট দূরত্বে রেখে খাঁচা খুলে দেওয়া হয়। খোলা দরজা পেয়েই মা মেছো বাঘটি মুক্তির দৌড় দেয়।

বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা মির্জা মেহেদী সরোয়ার গত বুধবার রাতে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, উদ্ধারকারী দল বিকেল চারটার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। ‘বাঘ’ দেখতে তখন শত শত মানুষ খাঁচাকে ঘিরে আছে। এই ভিড় ও কোলাহলের মধ্যেই বাচ্চাগুলো মায়ের বুকের দুধ পান করছে। স্থানীয় জনসাধারণকে তখন বোঝানো হয়, এই প্রাণীকে নিয়ে ভীত হওয়ার কিছু নেই। বন্দী অবস্থায় চারটি বাচ্চা প্রসব করে বিপদে রয়েছে বাঘটি। একে যদি তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া না হয়, তাহলে মাসহ বাচ্চাগুলো মৃত্যুর মুখে পড়বে। এ সময় উদ্ধারকারী দলের সদস্যরা উপস্থিত জনগণের মধ্যে সচেতনামূলক প্রচারপত্র বিলি করেন। এতে ইউসুফ মিয়াসহ সাধারণ জনগণের ভুল ভাঙে।

মির্জা মেহেদী সরোয়ার বলেন, একপর্যায়ে বাচ্চাসহ মেছো বাঘটিকে ঘটনাস্থলের পাশের বাঁশঝাড়ে অবমুক্ত করতে সবাই একমত হন। উৎসুক জনগণকে নির্দিষ্ট দূরত্বে রেখে খাঁচা খুলে দেওয়া হয়। খোলা দরজা পেয়েই মা মেছো বাঘটি মুক্তির দৌড় দেয়। এরপর বাচ্চাগুলো নিয়ে চলে অপেক্ষার পালা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে সবাইকে চমকে দিয়ে বাঘটি এসে ছানাগুলোকে নিয়ে যায়। মেছো বাঘ ও তার ছানাদের নিয়ে কয়েক ঘণ্টার জল্পনা এক স্বস্তির পরিণতিতে গিয়ে শেষ হয়েছে। স্থানীয় জনগণ দেখলেন, বন্য প্রাণী হলেও সন্তানের প্রতি মায়ের দরদ। তারাও অঙ্গীকার করলেন, ভবিষ্যতে মেছো বাঘ ধরবেন না, মারবেনও না। মেছো বাঘ ফাঁদ পেতে ধরা, শিকার, হত্যা, পাচার ও ক্রয়-বিক্রয় করার জন্য দুই বছরের কারাদণ্ড, এক লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।

আঞ্চলিকভাবে এটিকে মেছো বাঘ ডাকা হলেও এটি আসলে বাঘ নয়। এটি বিড়ালজাতীয় প্রাণী। এর প্রকৃত নাম মেছো বিড়াল। প্রাণীটি মানুষকে আক্রমণ করে না। বরং মানুষকে ভয় পায়। এ ছাড়া প্রাণীটি ইঁদুর ও ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে ফসলের উৎপাদন বাড়ায়।

বন্য প্রাণী গবেষক সূত্রে জানা গেছে, সারা বিশ্বেই মেছো বাঘ এখন সংকটাপন্ন। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থাগুলোর সংগঠনÑআইইউসিএন মেছো বাঘকে সংকটাপন্ন প্রাণী হিসেবে লাল তালিকাভুক্ত করেছে। প্রাকৃতিক জলাভূমি কমার কারণে এদের জনসংখ্যা কমে আসছে। অথচ কোনো জলাভূমির আশপাশে মেছো বাঘ থাকলে, সেখানে মাছের পরিমাণ বাড়ে। মেছো বাঘ বেশির ভাগ সময়ই মরা ও রোগাক্রান্ত মাছ খেয়ে জলাশয়ে মাছের রোগ নিয়ন্ত্রণ করে।

বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে আর মেছো বাঘ অবমুক্ত করব না। যেখান থেকে উদ্ধার ও যেখানে মেছো বাঘের উপযোগী পরিবেশ-প্রতিবেশ রয়েছে, যেখানে ভালো থাকবে, পরিচিত সঙ্গী-সাথি থাকবে, সেখানেই ছাড়া হবে। দেখেছি, লাউয়াছড়ায় অবমুক্ত মেছো বাঘ এখানে থাকছে না। এরা হাওরের কাছাকাছি থাকে। হাওরের দিকে চলে যায়।’