ফুলের আড়ালে যাঁদের কাঁটার জীবন
মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলায় বাড়ি ছিল খুকু চ্যাটার্জিদের। সেই সময়ের প্রমত্তা কুমার নদের ভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়ে পাড়ি জমান খুলনায়। স্বামী কাজ করতেন একটা বেসরকারি পাটকলে। ঘর হারানোর বেদনা কাটিয়ে ভালোই চলছিল সংসার। তবে বিধিবাম। সেই ভালো থাকাটা স্থায়ী হওয়ার আগেই মারা গেলেন স্বামী। স্বজনহীন পরিবেশে অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়ে যেনো অথৈ সাগরে পড়লেন খুকু। পাঁচ-ছয় বছরের ছোট ছেলেকে নিয়ে এদিক সেদিক নানা কাজ করে একসময় লেগে পড়লেন ফুল বিক্রিতে। গোলাপ-রজনীগন্ধা ফুল নয়; জবা, টগর আর গাছ থেকে পাড়া হরেকরকম পূজার ফুল বিক্রির করেন খুকু। বয়স খুকুর এখন ষাট পেরিয়েছে। পূজার ফুল বিক্রি করছেন প্রায় ২০ বছর ধরে।
খুকু চ্যাটার্জি বলেছিলেন, ‘একখান কাপড় সাত তালি দিয়ে চলেছি। এমন সময় গেছে আমি তিন দিন পরে একমুঠ ভাত খেয়েছি। পয়সার অভাবে ছেলেকে পড়াতে পারিনি। ঠিকমতো ভাত দিতি পারিনি। তারপরও মেট্রিক পাস করিয়েছি। এখন ছেলে সকালে একটা গুদামে কাজ করে। পরে ভ্যান নিয়ে বেরোয়। উপরওয়ালা ভালোই রেখেছেন।’
খুকুরা এখন থাকেন শহরের পাশের ভৈরব নদের ওপার রাজাপুরে। ছেলে-বৌমা আর নাতনি মিলে চারজনের সংসার। ফুল তুলতে চলে যান আশপাশের গ্রামে। গ্রামে তিনি অনেক ফুল গাছ লাগিয়ে রেখেছেন। এ ছাড়া অন্যের বাড়ির ফুলও সংগ্রহ করেন। অনেক বছরের পরিচয়ে কেউ তাঁর কাছ থেকে ফুল তোলার জন্য টাকা নেন না। বরং ডেকেই ফুল দেন। ক্রেতারা সবাই তাঁকে মাসি বলেই ডাকেন।
খুকু চ্যাটার্জির সঙ্গে শনিবার কথা হয় খুলনার কেন্দ্রীয় মন্দির আর্য ধর্মসভা মন্দিরের পাশের ফুটপাতে। সেখানে খুকুর মতো পূজার ফুল বিক্রি করছেন অনেক নারী। নগরের বাইতিপাড়া এবং দোলখোলা শীতলাবাড়ি মন্দির এলাকাতেও নারীরা এভাবে ফুল বিক্রি করেন। এসব নারীদের গল্প আলাদা। তবে গল্পের মূল সুর অভিন্ন। তাঁদের জীবন বীণায় হরদম বেজে যায় অভাব-অনটন আর সংগ্রামের তান।
খুকুর থেকে কয়েক গজ দূরে বসে ফুল বিক্রি করছিলেন সুনীতা বকশি। ডুমুরিয়ার শিবপুর গ্রামে বাড়ি সুনীতার। ফজরের আযানের পর সবকিছু গুছিয়ে বের হন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। প্রায় তিন কিলোমিটার হেঁটে প্রথমে কৈয়া বাজার আসেন। তাঁর পর ইজিবাইকে খুলনা শহর। হাঁটা বাদে শহরে আসতে প্রতিদিন খরচ হয় ৪০ টাকার মতো। যাওয়ার সময়ও সমপরিমাণ খরচ। বাবা-মায়ের সঙ্গতি ভালো না থাকায় ক্লাস এইটে উঠেই বিয়ে হয় তাঁর। তিন মেয়েকে নিয়ে সুনীতার সংসার ছিল। তিন মেয়ের ছোটটা যখন পেটে স্বামী তখন অন্য এক নারীকে নিয়ে ভারতে চলে যান। এরপর থেকে সংগ্রাম শুরু সুনীতার। এক সময় ননদের পরামর্শে ফুল বিক্রির ব্যবসায় নামেন। এরপর তিন মেয়েকে কমবেশি পড়াশোনা করিয়েছেন। বিয়েও দিয়েছেন।
সুনীতা বলেন, ‘সংসার চালানো যখন অসম্ভব হয়ে পড়ছিল তখন ননদের পরামের্শে এ কাজে আসি। প্রথম প্রথম খুব কষ্টের জীবন গেছে। পরে ব্যবসা থেকে তিন মেয়েকে পড়িয়েছি, বিয়ে দিয়েছি। জমানো টাকা আর শ্বশুরের দেওয়া কিছু জমি বিক্রি করে একটা থাকার জায়গা করছি। এখন অভাব থাকলেও আগের চেয়ে ভালো আছি।’
পূজার ফুল হিসেবে নারীরা গাঁদা, লাল জবা, হলুদ জবা, সাদা জবা, অপরাজিতা, বেলি, টগর, গন্ধরাজ, আশোক, লাল-হলুদ করবী, ধুতরা, আকন্দ ফুল বিক্রি করেন। তাঁদের কাছেই মেলে দুর্বা, বেল পাতা, তুলশী পাতা, আমপাতা, কলা পাতা এসব পূজার সামগ্রী। সাধারণত ভোর থেকে শুরু হয়ে সকাল নয়টার মধ্যে বিক্রি শেষ হয়। পাঁচ টাকা, দশ টাকা ভাগ হিসেবে ফুল বিক্রি হয়। একেক জনের পরিচিতি অনুসারে বেচা–বিক্রি কম বেশি হয়। অনেকে ফুল কিনে আনেন। তবে সাধারণত প্রতিদিন ২০০ থেকে ৫০০ টাকার বিক্রি করেন তাঁরা। সোমবার আর বৃহস্পতিবারে বিক্রি হয় সবচেয়ে বেশি ফুল। অন্য বিশেষ পূজার দিনগুলোতেও প্রচুর ফুল বিক্রি হয়। ভোরবেলা হাঁটতে বের হওয়া নারী-পুরুষ মূলত এই ফুলের ক্রেতা। তবে কেউ কেউ শুধু ফুল কিনতেই এসব জায়গায় আসেন।
ধর্মসভা মন্দিরে পাশে সবচেয়ে বেশি ফুল বিক্রি হয় লিপিকা মণ্ডলের। ওই এলাকায় তিনি যে বেশ জনপ্রিয়, তা ক্রেতাদের কথা শুনেই বোঝা গেল। কৈয়াবাজার এলাকা থেকে আসেন তিনি। ৫ বছর ধরে ফুল বিক্রি করছেন। তাঁর নিজের ফুলের বাগান আছে। ভোর চারটায় ঘুম থেকে উঠে ফুল তোলেন। এ জন্য তাঁর ফুল বেশি টাটকা থাকে। পরিমাণেও দেন বেশি। লিপিকাদের কোনো ফসলি জমি নেই। আছে শুধু বসত ভিটে। স্বামীর আয়ে সংসার না চলায় এই পেশায় আসেন তিনি।
লিপিকা বললেন, ‘ছোট থেকেই বাবা-মা ছিল না। ছোট বেলাতেই বিয়ে হয়। এক সময় সংসার চলছিল না। তারপর এখানে আসি। ভালোই চলছিল। তবে মেজো মেয়েটার জটিল অপারেশন করতে গিয়ে অনেক দেনা হয়েছি। ছোটটা টেনে পড়ে। মাসে ওর পড়ার খরচ লাগে ২ হাজার টাকা। এর ওপর চাল–তেল সব কিছুর দাম বেশি। খাবো কী? কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তবে অনেক বেকায়দায় পড়লে এখানকার ক্রেতারা সাহায্য করেন।’
নগরের বাইতিপাড়া মোড়ে বসে চার জন নারী ফুল বিক্রি করছিলেন। তাঁদের সবার জীবনেও কষ্টের গল্প। সেই গল্প শোনার শুরুতেই তেরখাদার অজগড়া থেকে আসা প্রভাভী বৈরাগি বলে উঠলেন, কষ্টের সংসার না হলে এতো ভোরে কষ্ট করে কেউ এতদূর আসে, বলেন!