খোলা দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে উন্মত্ত নদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন ষাটোর্ধ্ব রিনা বেগম। ভঙ্গিতে অনিশ্চয়তা, উৎকণ্ঠা। প্রমত্তা পশুরের তুফানের তাণ্ডবে যেন কিছুটা ভীত। আম্পানে ঘর হারানোর স্মৃতি মনে এসে হয়তো সেই উৎকণ্ঠাকে আরও উসকে দিচ্ছিল। ‘কেমন আছেন?’ জিজ্ঞাসাতে যেন ভাবনায় ছেদ পড়ল রিনা বেগমের। নদের দিক থেকে মুখ না ফিরিয়েই আনমনে বলে উঠলেন, ‘আর আমাদের থাকা।’ এরপর দৃষ্টি ঘোরালেন। খুলে দিলেন দুঃখ আর কষ্টে ভরা কথা আর স্মৃতির ঝাঁপি।
রিনা বেগম বলেন, যখন পশুর নদ অনেকটা ছোট ছিল, ২৫ পয়সায় খেয়া পার হওয়া যেত, তখন তিনি এখানে এসেছেন। এরপর জীবনে বহু ঝড় দেখছেন। গত কয়েক বছর ঝড়ের পরিমাণ আর ভয়াবহতা দুটোই বেড়েছে। গত বছরের আম্পানে সব হারিয়েছিলেন। নতুন করে আবার ঘর তুলেছেন। তবে চলতি ইয়াসের প্রভাবে যে পরিমাণ পানি বাড়ছে, আর ঘরের চালসমান তুফান হচ্ছে, তাতে কতক্ষণ ঘর টিকে থাকবে, তা নিয়ে ভীষণ শঙ্কা তাঁর।
রিনা বেগম খুলনার উপকূলীয় উপজেলা দাকোপের বানীশান্তা যৌনপল্লির বাসিন্দা। দেশ স্বাধীনের অনেক আগেই ওই যৌনপল্লি গড়ে উঠেছিল। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। নদে তখন জোয়ারের তীব্রতা বাড়ছিল। ফুঁসে ওঠা পানিতে ভাঙছিল পাড়। তাঁর কথা বলার ফাঁকে যোগ দিলেন পাশের ঘরের নূরজাহান বেগম (৬০)। বাড়িওয়ালি নুরজাহানের পাঁচটা ঘরের চারটায় ভাড়াটে (যৌনকর্মী) আছে। তবে করোনার পর থেকে ভাড়ার টাকা পান না। নূরজাহান বলেন, মেয়েরা ভাড়া দিতে পারছেন না। তাঁদের আয়-ইনকাম নেই বললেই চলে। তার ওপর দোকান থেকে তাঁদের বাকি দিতে হচ্ছে। একেকজনের কাছে ৪০-৫০ হাজার টাকা পাওনা হয়ে গেছে। সবারই না খেয়ে মরার জোগাড় হয়েছে। আর এই যে ঝড় গেল, খরিদ্দার কিছুদিন মোটেই এমুখো হবেন না। ঝড়-তুফানের ভয় সবাই পান।
রিনা বেগম বলেন, গত বছরের আম্পানে সব হারিয়েছিলেন। নতুন করে আবার ঘর তুলেছেন। তবে চলতি ইয়াসের প্রভাবে কতক্ষণ সেই ঘর টিকে থাকবে, তা নিয়ে ভীষণ শঙ্কা তাঁর।
নূরজাহান আরও বলেন, ‘এই নদের কারণে সামনে ভাঙে আমাদের পিছিয়ে যেতে হয়। আম্পানের ক্ষত এখনো কাটিয়ে ওঠা যায়নি। সে সময় বেশির ভাগ ঘর পড়ে গিয়েছিল। আবার ধারদেনা করে সবাই নতুন করে ঘর খানিকটা পিছিয়ে নিয়েছে। তবে তুফানের যে গতি মনে হয়, এগুলোও টিকবে না।’
ছয় বছর আগে দেশের উত্তরের এক জেলা থেকে এই যৌনপল্লিতে এসেছেন নূরী। তাঁর আপনজনেরা জানেন তিনি চাকরি করেন। নূরী বলেন, ‘এরই মধ্যে বড় চারটি ঝড় দেখলাম। মাত্র দেড় মাস আগে অনেক টাকা দিয়ে নতুন ঘর করেছি। তবে ভাড়া এখনো হয়নি। আর আয়ও নেই। জাহাজের কাস্টমার নেই, টুরিস্টরাও এখন নামে না। যে তুফান হচ্ছে আর ঘরের সামনে সমানে ভাঙছে, তাতে মন বিচলিত হয়ে উঠেছে। এবার ঘর চলে গেলে মরে যেতে হবে।’ একটু পরে আবার বললেন, ‘পেটের কষ্ট তো চলছেই। থাকা নিয়েও চিন্তা। সুযোগ পেলে বাড়ি বেচে চলে যাব। এত রিস্ক নিয়ে আর থাকা যায় না।’
বৃহস্পতিবার ওই যৌনপল্লি ঘুরে এবং যৌনকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এলাকায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাঁধ হয়েছে, তবে ওই যৌনপল্লি সেটার বাইরে পড়েছে। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাব কেটে গেলেও জোয়ারের পানির উচ্চতা কমছে না। বড় বড় তুফান আছড়ে পড়ছে পাড়ে। পানি ঢুকে যাচ্ছে ঘরের ভেতর। বাতাসের তোড়ে সেখানে দাঁড়ানোয় দায়। রাস্তা নদে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। কিছু জায়গায় রাস্তা নদগর্ভে চলে গেছে। মোংলা বন্দর তেমন জমজমাট না থাকায় তাঁদের আয়ও এমনিতেই কমেছে। আর করোনা-লকডাউনে আয় প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। আম্পান তাঁদের নিঃস্ব করে দিয়েছিল। ইয়াসেও ওই পল্লির অনেক ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘরের সামনে থেকে মাটি সরে গেছে। যেকোনো সময় তা পড়ে নদগর্ভে বিলীন হতে পারে। বাড়িওয়ালিদের চেয়ে ঘর ভাড়া করে থেকে যৌনসেবা বিক্রি করা কর্মীদের কষ্টটা বেশি। প্রায় সবার মুখে হতবিহ্বল অসহায়তা লেপ্টে রয়েছে।
এই যৌনপল্লিতে ৩৭টি বাড়িতে ২৫০-এর মতো ঘর আছে। আর বাড়িওয়ালি ও সক্রিয় যৌনকর্মী আছেন সব মিলিয়ে ৯২ জন। যৌনকর্মী মালা সম্প্রতি বাড়িওয়ালি হয়েছেন। মাস দুয়েক আগে জমানো দুই লাখ টাকায় বাড়ি কিনেছেন। তবে ভাড়া নেই। নিজের ব্যবসাও নেই। দোকানেও বেচাবিক্রি চলছে বাকিতে। সন্তানদের ঠিকমতো টাকা পাঠাতে পারছেন না। মালা বলেন, ‘এত খারাপ সময় আগে কখনো আসেনি। সবার অবস্থা খারাপ, বয়স্ক ব্যক্তিদের অবস্থা বেশি খারাপ। অনেকের দুই বেলা চুলা জ্বলে না। করোনা-লকডাউন তো আছে, সঙ্গে এখানে প্রায় সাত মাস বর্ষা-কাদা থাকে, লোকজন আসে না।’
মালা আরও বলেন, পল্লির আশপাশে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নেই। বেশ দূরে একটা আশ্রয়কেন্দ্র থাকলেও সেখানকার স্থানীয় লোকজনের চাপে তা ভরে যায়। আবার অনেকে তাঁদের খারাপ মেয়ে হিসেবে দেখেন। এ জন্য আশ্রয়কেন্দ্রে জায়গা দিতে চান না।
একজন যৌনকর্মী বলেন, ‘আমাদের অনেকেই ঝড়ের সময় আশপাশের গ্রামের অনেক বাড়িতেই আশ্রয় নেয়। আগে অনেকে ঘেন্না করলেও এখন আশ্রয় চাইলে পাওয়া যায়। আবার অনেকে ঝড়ের কিছু আগে পাশের গ্রামে বাড়ি ভাড়া করে মালামাল সরিয়ে নেয়। আর ঘূর্ণিঝড়ের আগে পরের জোয়ারের পানিতে আমাদের বিপদ ভীষণ বাড়ে। তবে বিপদ আর কষ্ট দেখার লোক নেই। শুনি আমাদের পুনর্বাসন করা হবে। তা–ও হয় না, আবার ঘরের সামনের নদে ভাঙনরোধে পাথরের ব্লক দেবে, তা–ও দেয় না। সাহায্য–সহযোগিতাও তেমন নেই।’ আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, ‘জীবনভর কামাই করেছি, তবে সঞ্চয় করিনি। দোষ তো আমাদের। পরের কাছে চেয়ে আর কী হবে।’
ওই পল্লির মানুষ যাঁর ওপর সবকিছুতে ভরসা খোঁজেন, তিনি রাজিয়া। নারী জাগরণী সংঘের সভানেত্রী। রাজিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কোনো সহায়তা মিলছে না। এ বছর সহায়তা বলতে ঈদের আগে ৪৫০ টাকা করে ফিতরার টাকা। আর আমাদের বড় ভয় হচ্ছে ঝড়-তুফানের ভয়। আশ্রয়কেন্দ্রও নেই। প্রতিবছর মেয়েরা ঋণ করে ঘর ঠিক করে আবার ভাঙে। এখানে আয় ৩ টাকা আর ব্যয় ৯ টাকা। ঋণের দায়ে অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বাড়িওয়ালি অনেকের ঘরেই বাজার নেই, অনেকের চুলা জ্বলে না। আর সাধারণ মেয়েদের অবস্থা বোঝেন তাহলে!’
এমন বিপদগ্রস্ত পরিস্থিতিতে ভীষণ আকুতি নিয়ে রাজিয়া বলেন, ‘সরকার চাইলেই আমাদের এখানে বাঁচাতে পারে। অন্তত আমাদের পল্লির সামনে বেড়িবাঁধ দিয়ে, নিতান্ত তা না হলে ব্লক ফেলে আমাদের ঝড়-তুফানের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। ঘরটা অন্তত টিকে থাকলে চিন্তা তো কিছুটা কমে।’