বন উজাড় করে জনবসতি ঘেঁষে পাহাড়ে ৬৪ ইটভাটা

বান্দরবান শহরতলির চাইঙ্গ্যা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উত্তর পাশে বন বিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চলসংলগ্ন ইটভাটা।
ছবি: প্রথম আলো

তিন পার্বত্য জেলায় ইটভাটা করার কোনো অনুমতি নেই। তারপরও পাহাড় কেটে, বনের কাঠ পুড়িয়ে বান্দরবানে অবৈধভাবে চলছে ৬৪টি ইটভাটা। আইনের তোয়াক্কা না করে জনবসতি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বন ঘেঁষে গড়ে তোলা হয়েছে এসব ভাটা।

জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তিন পার্বত্য জেলায় ইটভাটার অনুমতি না দেওয়ার জন্য ২০০৮ সালে পরিপত্র জারি করা হয়। এ জন্য বান্দরবানে কোনো ইটভাটার অনুমতিপত্র দেওয়া হয় না এবং জেলায় বৈধ কোনো ইটভাটা নেই। তবে ১২টি ভাটার মালিক শর্ত সাপেক্ষে উচ্চ আদালতের আদেশে তাঁদের ভাটা পরিচালনা করছেন।

জেলার সাতটি উপজেলায় ৬৪টি ইটভাটার মধ্যে শুধু ফাইতং ইউনিয়নে ২৮টিসহ লামায় রয়েছে ৩৩টি ভাটা। এ ছাড়া বান্দরবান সদর উপজেলায় ১৪টি, নাইক্ষ্যংছড়িতে ৯টি, আলীকদমের ৩টি, থানচিতে ২টি, রুমায় ২টি ও রোয়াংছড়িতে ১টি ইটভাটা রয়েছে।

সম্প্রতি সরেজমিন দেখা যায়, পরিবেশের জন্য অতিমাত্রায় ক্ষতিকর ২৫টি ড্রাম চিমনি, ১২০ ফুট উঁচু কংক্রিটের তৈরি চুল্লি ৩৪টি ও ৫টি জিগজ্যাগ পদ্ধতির ইটভাটায় ইট পোড়ানো হয়। লামায় ১৩টি, নাইক্ষ্যংছড়িতে ৬টি, থানচি, আলীকদম ও রুমায় ২টি করে ড্রাম চিমনির ইটভাটা আছে। ইট প্রস্তুত ও ইটভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রণ আইনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বনাঞ্চল ও পাহাড়সংলগ্ন কোনো ইটভাটা স্থাপন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ইটভাটা পাহাড় কেটে জ্বালানি সংগ্রহের সুবিধার্থে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের কাছাকাছি স্থাপন করা হয়েছে। ৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয়সংলগ্ন ১২টি ইটভাটা নির্বিঘ্নে চলতে দেখা গেল।

বিদ্যালয়সংলগ্ন ইটভাটা

বান্দরবান সদর উপজেলার গুংগুরুপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মংহ্লাপ্রু খেয়াং বললেন, গুংগুরুপাড়া বিদ্যালয়সংলগ্ন ইটভাটাটি বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন, স্মারকলিপিসহ বহু আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু মালিকের লম্বা হাত ও টাকার কারণে ইটভাটা বন্ধ হয়নি। পরে তিনি উচ্চ আদালতে ভুল তথ্য দিয়ে ইটভাটা চালানোর আদেশ নিয়ে এসেছেন। ভারী যানবাহনের শব্দ, ধুলাবালুতে শিক্ষকেরা পাঠদান ও শিক্ষার্থীরা পাঠগ্রহণ করতে পারে না।

সরেজমিন গুংগুরুপাড়া বিদ্যালয়ের মতো আরও ৫টি বিদ্যালয়সংলগ্ন ১১টি ইটভাটা পাওয়া গেছে। সেগুলো হচ্ছে বান্দরবান সদর উপজেলায় চাইঙ্গ্যা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিন দিকে তিনটি, লামায় শিবাতলিতে চারদিকে চারটি, সুয়ালক হেডম্যানপাড়া ও আমতলিপাড়া, থানচি হেডম্যানপাড়া, নাইক্ষ্যংছড়িতে বৈক্ষ্যং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি করে ইটভাটা রয়েছে। শিক্ষকেরা বলেছেন, ইটভাটার মালিকদের ক্ষমতা ও অর্থের প্রভাব অনেক বেশি। এ জন্য সমস্যা হলেও কিছু বলা সম্ভব হয় না।

পাহাড় কেটে, কৃষিজমিতে ইটভাটা

লামা উপজেলার ফাইতং ইউনিয়নে ২৮টি ইটভাটা পাড়াসংলগ্ন পাহাড় কেটে ও কৃষিজমিতে স্থাপন করা হয়েছে। শিবাতলিপাড়া, মেংঅংপাড়া ও মংবাচিংপাড়ার মধ্যে দুটি পাহাড় ও দুটি টিলা কেটে চারটি ইটভাটা প্রায় এক দশক ধরে চলছে। এ ছাড়া ফাদুরছড়া, লম্বাশিয়া, রাইম্যাখোলা, মানিকপুর এলাকায় বিপজ্জনকভাবে পাহাড় কেটে ইটভাটা গড়ে তোলা হয়েছে।

বান্দরবান শহরতলির চাইঙ্গ্যা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে ইটভাটায় পোড়ানোর জন্য মজুত করে রাখা কাঠ।
ছবি: প্রথম আলো

শিবাতলিপাড়ার বাসিন্দা উচহ্লা মারমা ও ইউপির সাবেক সদস্য এমং মারমা বলেছেন, ইটভাটার চুল্লি জ্বালালে পুরো এলাকা উত্তপ্ত, ধুলাবালু ও কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। প্রতিটি ভাটায় কয়েক হাজার ঘনফুট জ্বালানি কাঠ মজুত থাকে।

বনাঞ্চল উজাড়

বর্তমানে বর্ষার কারণে ভাটায় ইট পোড়ানো বন্ধ। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে পোড়ানো শুরু হবে। এ জন্য লাকড়ি মজুত করা হয়েছে। চাইঙ্গ্যার এফবিএম ব্রিক্সের জ্বালানি মিস্ত্রি মো. জামাল উদ্দিন, এসঅ্যান্ডবির মো. মিলন হোসেন জানিয়েছেন, একটি ইটভাটায় এক দফা (১৬ দিন) ইট পোড়াতে গড়ে সাড়ে ছয় হাজার মণ জ্বালানি কাঠের প্রয়োজন। একটি ইটভাটায় প্রতিবছর ১০ দফায় ৬৫ থেকে ৭০ লাখ ইট পোড়াতে গড়ে সাড়ে ৬৫ হাজার মণ জ্বালানি কাঠ লাগে। সেই হিসাবে, বান্দরবানের সাতটি উপজেলায় ৬৪টি ইটভাটায় প্রতিবছর ৪১ লাখ ৯২ হাজার মণ বা ১ লাখ ৬৬ হাজার টন বনাঞ্চলের গাছ পোড়ানো হচ্ছে।

আরণ্যক ফাউন্ডেশন ও তাজিংডংয়ে সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, বান্দরবান জেলায় গত এক দশকে (২০১১-২০) কাঠ পাচার, তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণ ও ইটভাটায় জ্বালানি কাঠ ব্যবহারে সাড়ে চার হাজার একর প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ধ্বংস ও প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার বনভূমি উজাড় হয়েছে।

আইন কী বলে

ইট প্রস্তুত ও ইটভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনের ৫ (৩ক) ধারা অনুবলে, সরকার ২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। এতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে (সড়ক ও মহাসড়ক ছাড়া) শতভাগ ব্লক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অর্থাৎ, কোনো ইট ব্যবহার করা যাবে না। ইটভাটায়ও ধাপে ধাপে ইট পোড়ানো কমিয়ে ব্লক তৈরি নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। কিন্তু বান্দরবানে এখনো কোনো ইটভাটায় ব্লক তৈরি এবং সরকারি-বেসরকারি উন্নয়নকাজে ব্লকের ব্যবহার শুরু হয়নি।

গণপূর্ত বিভাগ (পিডব্লিউডি) বান্দরবানের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহরিয়ার নেওয়াজ বলেছেন, ব্লক ব্যবহার এখনো শুরু হয়নি। তবে আগামী অর্থবছরে সব উন্নয়ন কাজে ৩০ শতাংশ ব্লক ব্যবহারের বিষয়টি দরপত্রেই শর্ত হিসেবে জুড়ে দেওয়া হবে।

ভাটামালিক ও প্রশাসনের কথা

ফাইতং ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি মুক্তার আহমেদ বলেছেন, জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করেও ইটভাটার অনুমতিপত্র মিলছে না। এ জন্য অবৈধ নয়, বাধ্য হয়ে অনুমতিপত্রবিহীন ইটভাটা চালাতে হচ্ছে। তবে প্রতিটি ইটের জন্য সরকারকে ভ্যাট দেওয়া হচ্ছে।

বান্দরবানের ইটভাটার মালিক মোহাম্মদ ইসলাম বলেছেন, অনুমতিপত্র না পেয়ে তাঁরা ১২টি ইটভাটার মালিক উচ্চ আদালতে রিট করেছিলেন। আইন অনুযায়ী, জেলা পরিবেশ কমিটি কর্তৃক স্থান নির্ধারণ করে না দেওয়া পর্যন্ত ইটভাটা পরিচালনার জন্য আদালত আদেশ দিয়েছেন। বিদ্যালয়সংলগ্ন ইটভাটার ব্যাপারে স্থানীয়ভাবে কারও আপত্তি নেই বলে দাবি করেন তিনি।

জানতে চাইলে বান্দরবানের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা সায়েদুল ইসলাম বলেছেন, জেলা প্রশাসন থেকে ইটভাটার লাইসেন্স দেওয়ার সময় বনবিভাগকে জানানো হয় না। এ জন্য কোথায় কোথায় ইটভাটা স্থাপন হয়েছে তাঁদের জানা থাকে না। তারপরও সংরক্ষিত বনাঞ্চলসংলগ্ন ভাটাগুলোতে মাঝেমধ্যে বনবিভাগসহ যৌথ অভিযান হয়ে থাকে। এ ছাড়া বনবিভাগের আর করার কিছুই নেই।

বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভিন তীবরিজী প্রথম আলোকে বলেছেন, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ২০০৮ সালের নির্দেশনা অনুযায়ী, তিন পার্বত্য জেলা এবং চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি এলাকার ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটার অনুমতিপত্র দেওয়া যাবে না। এ জন্য কোনো ইটভাটার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না এবং বান্দরবানে একটিও বৈধ ইটভাটা নেই। এক প্রশ্নের জবাবে জেলা প্রশাসক বলেন, প্রতিবছরই অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়। কিন্তু তাঁরা চলে আসার পর আবার ভাটা চালু হয়ে যায়।