বাঁশের মাচায় বৃদ্ধার বেঁচে থাকার লড়াই

জীর্ণশীর্ণ এই দোকান চালিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই করছেন ৭০ বয়সী আসমা বেগম। গতকাল শনিবার গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার দক্ষিণ পাকুল্লা গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার দক্ষিণ পাকুল্লা গ্রামের আসর উদ্দিনের স্ত্রী আসমা বেগম (৭০)। ৪০ বছর আগে স্বামী মারা গেছেন। নেই কোনো সন্তান। একাকিত্ব ঘোচাতে একটি মেয়েকে দত্তক নেন। বিয়েও দিয়েছিলেন তাঁকে। কিন্তু সেই সংসার টেকেনি। অভাবের সংসারে খেয়ে-পরে বাঁচতে রাস্তার মোড়ে বাঁশের মাচায় চিপস, চানাচুর আর বিস্কুট বিক্রি করেন আসমা বেগম। তা দিয়েই চলে মা ও মেয়ের বেঁচে থাকার সংগ্রাম।

গতকাল শনিবার সকালে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় আসমার সঙ্গে কথা হয়। আসমা বেগম বললেন, ‘রিকশা লইয়া হাটে যাওনের সময় ঝাঁকুনিতে দুইবার পইড়া গেছিলাম। পইড়া গিয়া পায়ের মধ্যে লাগছে। এহন কষ্ট হইতাছে। দুইবার পইড়া গেলাম কিন্তু ক্যান যে মইরা গেলাম না।’ মৃত্যু কামনার কারণ জানতে চাইলে আসমা বলেন, ‘এত দুঃখ-কষ্ট আর সহন যাইতাছে না। হের লাইগা কইতাছি, মইরা গেলেই ভালা অয়তো।’

রিকশা লইয়া হাটে যাওনের সময় ঝাঁকুনিতে দুইবার পইড়া গেছিলাম। পইড়া গিয়া পায়ের মধ্যে লাগছে। এহন কষ্ট হইতাছে। দুইবার পইড়া গেলাম কিন্তু ক্যান যে মইরা গেলাম না। এত দুঃখ-কষ্ট আর সহন যাইতাছে না।
আসমা বেগম (৭০)

আসমা বেগম যখন কথাগুলো বলছিলেন তখন চোখ বেয়ে অঝোরে পানি ঝরছিল তাঁর। দেখে মনে হয়েছে, তাঁর চেয়ে দুঃখী মানুষ হয়তো আর কেউ নেই। সরকারি কিছু সহায়তা আর দোকান দিয়েই তাঁদের জীবন কেটে যাচ্ছে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আসমা বেগমের স্বামী আসর উদ্দিন কৃষক ছিলেন। তাঁকে নিয়ে ভালোই চলছিল সংসার। দাম্পত্যজীবনে তাঁদের কোনো সন্তান ছিল না। ৪০ বছর আগে তাঁর স্বামী মারা যান। সন্তান না থাকায় একা হয়ে পড়েন আসমা। পরে একটি মেয়ে দত্তক নেন তিনি। তাঁকে বিয়েও দিয়েছিলেন। কিন্তু পালিত মেয়ের সেই সংসার বেশি দিন টেকেনি। এখন মা ও মেয়ে কোনোভাবে সংসার চালিয়ে নিচ্ছেন। অনেক সময় ঠিকমতো খেতেও পারেন না। স্বামীর রেখে যাওয়া বাড়িতে দুটি ঘর আছে। মেরামতের অভাবে সেগুলোর অবস্থা জরাজীর্ণ। একটি ঘরে মা ও মেয়ে থাকেন, অন্যটিতে একটি বাছুর পালন করেন।

আসমা বেগম বলেন, গরিব কিন্তু ভিক্ষা করে তো খেতে পারি না। অল্প কিছু টাকা দিয়ে কিছু চিপস, বিস্কুট, চানাচুর, কটকটি স্থানীয় বেনুপুর বাজার থেকে কিনে আনেন। বাড়ির এক কিলোমিটার দূরে রাস্তার মোড়ে বিকেলে মানুষ আড্ডা দেয়। সেখানে একটি বাঁশের মাচায় সেগুলো বিক্রি করেন। কোনো দিন ১০০ আবার কোনো দিন ২০০ টাকা বিক্রি হয়। এমন দিনও আছে, যেদিন এক টাকাও বিক্রি হয় না। তাঁর দোকানে সর্বোচ্চ এক-দেড় হাজার টাকার মালামাল আছে।

দক্ষিণ পাকুল্লা গ্রামের বাসিন্দা ও অটোচালক রহিম বাদশা বলেন, মানুষটা বড়ই একা। সংসারও চলে টানাটানি করে। তাঁকে কিছু সহযোগিতা করতে পারলে তিনি খুব উপকৃত হবেন।

ওই বৃদ্ধা নারীর সঙ্গে কথা বলার সময় আশপাশের অনেকেই এগিয়ে আসেন। সবাই তাঁর পাশে দাঁড়াতে চান। উত্তর পাকুল্লা গ্রামের যুবক জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ছোট এই দোকান দিয়ে কারও সংসার চলতে পারে না। আগে আশপাশে কোনো দোকান ছিল না, তখন মোটামুটি চলত, কিন্তু এখন সব পাড়াতেই দোকান হওয়ায় তাঁর দোকানে তেমন বেচাবিক্রি হয় না।

আটাবহ ইউনিয়ন পরিষদের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. মোস্তফা হোসেন বলেন, তাঁকে বয়স্ক ও বিধবা ভাতা দেওয়া হয়। তাঁর পালিত মেয়েকে সহায়তার কার্ড দেওয়া হয়েছে। এরপর আর কোনো অনুদান এলে তাঁকে সহযোগিতা করা হবে।