রিকশা নিয়ে যাত্রীর অপেক্ষায় জাহাঙ্গীর হোসেন
ছবি: প্রথম আলো

জ্যৈষ্ঠের শেষ দিকে রোদের তেজে গা পুড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। বরিশাল নগরের ব্যস্ততম কাকলি মোড় ধরে যেতে যেতে দেখে হয় ৩০ বছর বয়সী এক রিকশাচালকের সঙ্গে। মলিন মুখ দেখেই বোঝা গেল, নিজের ভেতরে এক অস্থির অবস্থা চলছে তাঁর। না হয় প্রখর রোদের মধ্যেও তীর্থের কাকের মতো এভাবে কেউ যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করে!

বেইন্নাহালে দুইডা রুডি-ভাজি, এক কাপ চা খাইছি, হেইতে ৪০ টাহা শ্যাষ। অনেক আগে খিদা লাগযে, কিছু খাইলে যে ঘরে চাউল-সওদা নেতে পারমু না
জাহাঙ্গীর হোসেন, রিকশাচালক

অবশেষে যাত্রী হিসেবে উঠলেন এই প্রতিবেদক। জানা গেল রিকশাচালকের নাম জাহাঙ্গীর হোসেন। কাকলি মোড় থেকে পোর্ট রোডের দিকে এগোচ্ছিল জাহাঙ্গীরের ব্যাটারিচালিত রিকশা। যেত যেতে হলো আলাপ। তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে, তবু পেটে দানাপানি পড়েনি। কথা তুলতেই বললেন, ‘কোন বেইন্নাহালে (খুব সকালে) দুইডা রুডি-ভাজি, এক কাপ চা খাইছি, হেইতে ৪০ টাহা শ্যাষ। অনেক আগে খিদা লাগযে, কিছু খাইলে যে ঘরে চাউল-সওদা নেতে পারমু না।’

জাহাঙ্গীর থাকেন নগরের ভাটিখানা জোড়ামসজিদ এলাকায়। দেড় হাজার টাকা ভাড়ার এক কক্ষবিশিষ্ট ঘরেই ছোট্ট দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে সংসার পেতেছেন।

যেতে যেতে কথা এগোয়। জাহাঙ্গীর দুই বছর হলো সদরের জাগুয়া গ্রাম থেকে জীবিকার জন্য নগরে এসেছেন। প্রথমে ভাড়া নিয়ে রিকশা চালাতেন। কিন্তু এতে সময়মতো রিকশা জমা না দিলে কিংবা ভাড়া বাকি পড়লে মালিকের অনেক বাজে কথা হজম করতে হতো। আবার কোনো কোনো দিন ভালো রিকশা পেতেন না। মালিকদের এই কাজকারবার চলে তাঁদের নিজেদের মর্জি অনুযায়ী। তাই মাস ছয়েক আগে একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে ৬০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে একটি রিকশা কিনেছেন। কিন্তু এখন দৈনিক ভাড়া গুনতে না হলেও জীবন যে আর চলে না।

হারা দিন কষ্টের পর বাজারে যাই। একটু ভালো–মন্দ কিনি। কিন্তু সব জিনিসের দাম হোনলে কলইজায় মোচড় মারে।
জাহাঙ্গীর হোসেন

হর্ন দিতে দিতে আয়-ব্যয়ের হিসাব কষলেন জাহাঙ্গীর। প্রতিদিন সর্বোচ্চ আয় হয় ৭০০ টাকা। এর মধ্যে রিকশার চার্জ দিতে ১০০ টাকা চলে যায়। এরপর দৈনিক তাঁর নিজের চা-নাশতা অন্য খরচ মিলিয়ে ব্যয় হয় ১০০ টাকা। দেড় কেজি চাল আর শাকপাতা তেল-সওদায় যায় ৩০০ টাকা। মাসে ছয় হাজার টাকা (সপ্তাহে দেড় হাজার করে) ঋণের কিস্তি দিতে হয়। এরপর সব টাকা শেষ। বাকি থাকে দেড় হাজার টাকার ঘরভাড়া, বাচ্চাদের ওষুধ, চিকিৎসা, জামাকাপড় এবং পরিবারের অন্যান্য খরচ। শখের বিষয়টি উপেক্ষাই করতে হয় বরাবরের মতো।

বাকিটা কীভাবে চলে? প্রশ্ন শুনে খানিক হাসেন, আবার মলিন হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন জাহাঙ্গীর। বলেন, ‘ক্যামনে যে চলে নিজেই কইতে পারি না। ধারকর্জ করি আবার কোনো মাসে কিস্তি দেতে পারি না, কোনো মাসে বাসাভাড়া। এই রহমই তো চলতে অয়।’

এই আয়েই আগে মোটামুটি ভালো চলে যেত জাহাঙ্গীরের সংসার। কিন্তু নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন যে আর চলে না। নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। জাহাঙ্গীর আক্ষেপ করে বলেন, ‘হারা দিন কষ্টের পর বাজারে যাই। একটু ভালো–মন্দ কিনি। কিন্তু সব জিনিসের দাম হোনলে কলইজায় মোচড় মারে। দুইডা বাচ্চা ঘরে। একটার বয়স সাত আর ছোটডার দুই বছর। কবে যে বাচ্চাগুলার মোহে একটু মাস, মাংস, ডিম দিছি, কইতে পারি না।’

কেন পারেন না, সে ব্যাখ্যাও দেন জাহাঙ্গীর। বলেন, ‘আয় তো বাড়ে নায়, খরচ বাড়ছে। আগে সয়াবিনের কেজি কেনতাম ৮০ টাহায়, এহন হেইয়্যা ২২০ টাহা। চাউল কেনতাম ৩০ টাহায়, এহন ৫৫ টাহা। সব জিনিসের দামই তো বাড়তি আর বাড়তি।’

জাহাঙ্গীরদের মতো শ্রমজীবী, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত জীবনের এমন দুর্বিষহ অবস্থা আর আরেক দিকে পোর্ট রোডের আড়তগুলোর সামনে পণ্যবাহী ট্রাকের দীর্ঘ সারি। সেসব ট্রাক থেকে সারি ধরে পণ্যগুলো খালাস করছিলেন শ্রমিকেরা। জাহাঙ্গীর তাঁদের দিকে কাতর হয়ে তাকান, বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করেন, ‘ট্রাকে কইর‍্যা এত এত মাল আইতে লাগছে, কিন্তু হ্যারপরও দাম কমে না ক্যা?’ এ প্রশ্নের তো আসলেই কোনো জবাব নেই।