‘বানোত এবার নিঃস্ব হয়া গেইনো’

তিস্তা নদীতে পানি কমে যাওয়ার পর ভাঙন তীব্র হয়েছে। ঘরবাড়ি সরিয়ে নিচ্ছেন ভাঙন কবলিত মানুষ। পশ্চিম ইচলি, গঙ্গাচড়া, রংপুর, ২৩ অক্টোবর
ছবি: মঈনুল ইসলাম

‘নদীর বানোত হামার ঘর ভাসি গেলো, বাড়ির মাল সব নষ্ট হয়া গেইছে। জমি লিজ নিয়া মিষ্টি কুমড়া আবাদ করছিনো, তাও শেষ হয়া গেলো। বানোত এবার নিঃস্ব হয়া গেইনো। এলাও কোনো সরকারি সাহায্য পাই নাই। অন্যের বাড়িত আশ্রয় নিছি।’ আক্ষেপের সুরে কথাগুলো বললেন নদীভাঙনকবলিত রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারি ইউনিয়নের পশ্চিম ইছলি এলাকার কৃষক নাজমুল ইসলাম।

শুধু নাজমুল ইসলাম নন, এভাবে ওই গ্রামের আরও অনেকের বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার পাশাপাশি তাঁদের ফসলও নষ্ট হয়েছে এবারের আকস্মিক বন্যায়।

রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলায় নদীতীরবর্তী এলাকা থেকে পানি নেমে গেলেও তাদের দুর্ভোগ-কষ্ট এখনো রয়ে গেছে। ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। পানির স্রোতে ভেসে গেছে বাড়ির মালামালসহ সবকিছু। ঋণ করে জমি লিজ নিয়ে যে ফসল আবাদ করেছিলেন, তা নষ্ট হয়ে গেছে। এখন সেই ঋণের টাকা কীভাবে পরিশোধ করবেন, তা নিয়ে চিন্তার শেষ নেই ক্ষতিগ্রস্তদের।

ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক আবুল কাশেম বলেন, ‘বহু বছর ধরি এই জায়গাত আছি। এমন পানির স্রোত এই এলাকাত আগে কখনো দেখি নাই। এবার রাইতোত সব ভাসি নিয়া গের। এলা হামরা নিঃস্ব।’

নিঃস্ব হওয়া কৃষক সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘মানুষের বাড়িত আশ্রয় নিছি। এলাও কোনো সরকারি সাহায্য–সহযোগিতা পাই নাই। চেয়ারম্যান তালিকা করি নিয়া গেইছে। খালি খিচুড়ি ও শুকনা খাবার দিছে চেয়ারম্যান।’

রংপুরের গঙ্গাচড়ায় হঠাৎ উজান থেকে পাহাড়ি ঢল নেমে আসা পানিতে উপজেলায় তিস্তা নদীতীরবর্তী গ্রামে আকস্মিক বন্যা দেখা দেয়। গঙ্গাচড়া উপজেলার সাত ইউনিয়নের আনুমানিক ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হন। তাঁরা এখন নতুন করে ঘর গোছানোর কাজ শুরু করেছেন। তবে এসব পরিবার চরের জমিতে ধান, বাদাম, মিষ্টি কুমড়াসহ যেসব রবি ফসল আবাদ করেছিলেন, তা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে। ফলে সামনের দিনগুলোতে অভাব-কষ্ট আরও প্রকট আকারে দেখা দিতে পারে বলে তাদের আশঙ্কা।

ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজন জানান, এ বছর আবহাওয়া ভালো থাকায় এবং বন্যার পানি তেমন না ওঠায় চরের বিস্তর এলাকায় ব্যাপক ধান, কুমড়া, বাদাম, আগাম আলুসহ বিভিন্ন রবি ফসল চাষ করা হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ এভাবে নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় তাঁদের সব ফসলই নষ্ট হয়েছে।

লক্ষ্মীটারি ইউনিয়নের বাগেরহাট গ্রামের মানিক মিয়ার দুটি টিনের ঘর রাতের বানে নদীতে বিলীন হয়েছে। ঘরের মালামাল সরিয়ে নেওয়ার সময় পাননি। তিনি বলেন, ‘এলা থাকারই জায়গা নাই। বাঁধোত অন্যের বাড়িত যায়া উঠছি। তার ওপর শোগ ফসল নষ্ট হয়া গেল। এলা কেমন করি জীব চরবে এই চিস্তায় ঘুম ধরে না।’

একই গ্রামের নওশাদ মিয়া বলেন, ‘চোখের সামনোত পানিত ঘর ভাসি গেল। তার ওপর জমি লিজ নিয়া চরের জমিত মিষ্টি কুমড়া ও আগাম আলু আবাদ করা হইছিলো, তাও শেষ হয়া গেল। এলা ঋণের টাকা কেমন করি শোধ করমো, সেই চিন্তা করলে শরীর অবশ হয়া আইসে।’

এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাবাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে জানানো হয়েছে, পানি ইতিমধ্যে কমতে শুরু করেছে। তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার অনেক নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা লক্ষ্মীটারি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল্লাহেল হাদী বলেন, ‘নিজেদের উদ্যোগে মানুষদের খিচুড়ি রান্না করে খাওয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে তেমন কোনো সাহায্য পাওয়া যায়নি। শুধু শুনেছি, বানভাসি মানুষদের সাহায্য দেওয়া হবে।’

জেলা প্রশাসক আসিব আহসান বলেন, ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। নতুন করে চাল ও টাকা বরাদ্দ হয়েছে। প্রতিটি এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। সেটা ধরে সহায়তা করা হবে।