বাল্যবিবাহ
প্রতীকী ছবি

নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে ‘বিবাহের ঘোষণাপত্র’ তৈরি করে দিচ্ছেন একশ্রেণির অসাধু আইনজীবী। সেই ঘোষণাপত্রকে ঢাল বানিয়ে বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটছে। খুলনার পাইকগাছায় এমন ৯টি বাল্যবিবাহের তথ্য পাওয়া গেছে। এসব ঘটনায় অভিভাবকদের জরিমানা করেছে প্রশাসন। দুই আইনজীবীকে আসামি করে মামলাও হয়েছে পাইকগাছা থানায়।

স্থানীয় কাজিরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে ছেলেমেয়েদের এভাবে ‘বিয়ে’ দিচ্ছেন অভিভাবকেরা। পাইকগাছা উপজেলা কাজি সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল কাদির প্রথম আলোকে বলেন, নিকাহ রেজিস্ট্রাররা কোনো বিয়ে নিবন্ধন করার সময় ছেলেমেয়ের জন্মনিবন্ধন, স্কুল বা কলেজের সনদসহ বিভিন্ন কিছু যাচাই করেন। এ কারণে যদি কারও বয়স কম থাকে, তখন ওই বিয়ে নিবন্ধন করাতে অস্বীকার করেন তাঁরা। তখন ওই পক্ষ চলে যায় আইনজীবীর কাছে। ভুয়া জন্মনিবন্ধন নিয়ে নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে ‘বিবাহের ঘোষণাপত্র’ নামের একটি লিখিত নথি তৈরি করেন তাঁরা। এটিকেই অনেকে বিয়ে বলে চালিয়ে দিচ্ছেন।

উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ জুন থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত পাইকগাছায় ৯টি বাল্যবিবাহের ঘটনায় জরিমানা করেছে প্রশাসন। সব কটি ঘটনার ক্ষেত্রেই নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে কথিত বিয়ের ঘটনা ঘটেছে।

জানতে চাইলে পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ বি এম খালিদ সিদ্দিকী বলেন, করোনা ও স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় অভিভাবকেরা অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। আর বিয়ে দিতে তাঁরা নানাভাবে জালিয়াতির আশ্রয় নিচ্ছেন। এ কারণে বাল্যবিবাহ বন্ধ হচ্ছে না।

পাইকগাছা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. আবদুস সাত্তার বললেন, যাঁরা এমন অবৈধ কাজ করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

কথিত বিয়ের এমন ঘটনায় আইনজীবীদের বিরুদ্ধে ১৪ আগস্ট পাইকগাছা থানায় মামলা করেছেন এক মা। তাঁর অভিযোগ, অপ্রাপ্তবয়স্ক প্রতিবন্ধী মেয়েকে অপহরণের পর কৌশল করে ‘বিয়ে’ দেওয়া হয়েছে। মামলায় দুই আইনজীবীকে আসামি করেছেন তিনি। ওই ঘটনার পর সতর্কতা হিসেবে আইনজীবী, পুলিশসহ বিভিন্ন দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করেছে উপজেলা প্রশাসন।

৫ আগস্ট উপজেলার ভিলেজ পাইকগাছা গ্রামের এক কিশোরীর সঙ্গে গোপালপুর গ্রামের এক তরুণের বিয়ের আয়োজন করছিলেন অভিভাবকেরা। জন্মসনদ অনুযায়ী, মেয়েটির বয়স মাত্র ১২ বছর ৮ মাস, আর তরুণের বয়স ১৯ বছর। ১ আগস্ট নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে ১০০ টাকার একটি স্ট্যাম্পে ‘বিবাহের ঘোষণাপত্র’ দেওয়া হয়। সেখানে তরুণের বয়স ২২ ও মেয়েটির বয়স ১৯ বছর দেখানো হয়। ওই স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করেন পাইকগাছা সিনিয়র সহকারী জজ আদালতের আইনজীবী রেহানা পারভীন।

ঘোষণাপত্রে লেখা ছিল, ‘আমরা দেশের আইন মোতাবেক সাবালক ও সাবালিকা হইতেছি। দীর্ঘদিন যাবৎ আমরা একে অপরকে চিনি ও জানি। অতঃপর আমাদের উভয় পরিবারের অভিভাবকবৃন্দের সম্মতিক্রমে আমরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হইবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।’

ওই ‘বিয়ে’র ব্যাপারে জানতে চাইলে আইনজীবী রেহানা পারভীন বলেন, ‘স্ট্যাম্পে লেখার সময় দুই পক্ষের অভিভাবকেরাই উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা বর–কনের জন্মসনদ দিয়েছিলেন, সেই অনুযায়ী লেখা হয়। পরে জেনেছি, ওই জন্মসনদ ভুয়া। ব্যাপারটি নিয়ে আমি খুব বিব্রত।’

পাইকগাছায় কোথাও বাল্যবিবাহের কথা শুনলে তা যাচাই করার জন্য সেখানে পাঠানো হয় উপজেলা আনসার ও ভিডিপি প্রশিক্ষক মো. আলতাফ হোসেনকে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, যত বাল্যবিবাহের ঘটনা দেখা গেছে, অধিকাংশই নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে অ্যাফিডেভিট করে নেওয়া। কাগজপত্র যাচাই–বাছাই করে ও খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, মেয়ে বা ছেলের বয়স বেশ কম।

গত ৩০ জুলাই উপজেলার গদাইপুর ইউনিয়নের তোকিয়া গ্রামে এমনই একটি বিয়ের আয়োজন হচ্ছিল। খুলনা জজকোর্টের আইনজীবী কিউ এস আসাদুজ্জামান স্বাক্ষরিত ‘বিবাহের ঘোষণাপত্রে’ ছেলের বয়স লেখা ছিল ২৫ ও মেয়ের ১৮ বছর ৬ মাস।

উপজেলা আনসার ও ভিডিপি প্রশিক্ষক মো. আলতাফ হোসেন বলেন, জন্মনিবন্ধন যাচাই করে দেখা যায়, মেয়েটির বয়স মাত্র ১০ বছর ৬ মাস। আর ছেলের বয়স ৩৪ বছর।

জানতে চাইলে আইনজীবী কিউ এস আসাদুজ্জামান বলেন, অনেক সময় ছেলে-মেয়েদের বয়স যাচাই করা হয়, অনেক সময় হয় না। দুই পক্ষ থেকে যে বয়স বলা হয়, সেটিই লেখা হয়। তাঁরা শুধু আইনজীবী হিসেবে লেখার কাজটি করেন।

যাঁরা নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে ওই কাজ করছেন, সেসব আইনজীবীকে আইনের আওতায় আনা দরকার বলে মনে করেন পাইকগাছার ইউএনও এ বি এম খালিদ সিদ্দিকী। তিনি বলেন, এই কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে পাইকগাছা আইনজীবী সমিতিকে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে।