দৃশ্যটা সুন্দর। নদীর পাশে পায়ে চলা পথ ঘেঁষে বটের ছায়ায় চলছে লেখাপড়া। সুনসান নীরব পরিবেশে কেবল শিশুদের কোলাহল। দূর থেকে দেখলে মনে হবে তপোবনের কোনো আশ্রম। তবে তা কেবলই বিভ্রম। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যালয় ভবন পরিত্যক্ত হওয়ায় গাছতলায় বাধ্য হয়ে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চালিয়ে নিতে হচ্ছে শিক্ষকদের। রোদ, বৃষ্টি, ঝড়—সব তুচ্ছ করেই বিদ্যালয়টি চালু রেখেছেন শিক্ষকেরা।

এ চিত্র খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার ভাইবোনছড়া ইউনিয়নের জোরমরম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। খাগড়াছড়ি শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে চেঙ্গী নদীর তীরে জোরমরম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টির অবস্থান।

গত বছর ৩ নভেম্বর ভূমিকম্পের পর চার কক্ষবিশিষ্ট জোরমরম বিদ্যালয়ের একতলা ভবনের বিভিন্ন অংশে দেখা দেয় ফাটল। খসে পড়ে পলেস্তারা। বিষয়টি জানার পর ৫ নভেম্বর তৎকালীন সদর উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা বিদ্যালয় ভবনে পাঠদান না করার জন্য শিক্ষকদের লিখিতভাবে নির্দেশ দেন। করোনার কারণে দীর্ঘ ছুটির পর ২ মার্চ বিদ্যালয়টিতে আবার পূর্ণকালীন পাঠদান শুরু হয়েছে। তবে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ছেড়ে গাছতলায় ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষকেরা।

১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত জোরমরম বিদ্যালয়টি এলাকা অন্যতম পুরোনো বিদ্যালয়। একসময় কাঠ আর বাঁশের বেড়ার ভবনে চলত পাঠদান। তবে স্থানীয় প্রকৌশল বিভাগ ১৯৯৪ সালে পাকা ভবন নির্মাণ করার পর সেখানেই এত দিন পাঠদান চলছিল। বর্তমানে বিদ্যালয়ে ১২৩ জন শিক্ষার্থী ও চারজন শিক্ষক রয়েছে।

সম্প্রতি ভাইবোনছড়া এলাকায় জোরমরম বিদ্যালয়ে গেলে বেশ দূর থেকেই শোনা যায় শিক্ষার্থীদের পড়া মুখস্থ করার শব্দ। বটতলায় তিনটি চেয়ারের ওপর তিনটি হোয়াইট বোর্ড। সেখানে তিন ভাগে ভাগ হয়ে মাদুর বিছিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন তিনজন শিক্ষিকা। গাছের পাতা চিরে রোদ এসে পড়ছে শিক্ষার্থীর চোখেমুখে। বিদ্যালয়ের এক পাশে গ্রামীণ সড়ক। সেদিক দিয়ে যাতায়াত করা লোকজনের দিকেও মনোযোগ শিক্ষার্থীদের।

পড়ানোর এক ফাঁকে কথা হয় সহকারী শিক্ষিকা সুজিতা চাকমার সঙ্গে। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা যেখানে শ্রেণিকক্ষের বদ্ধ পরিবেশেও মনোযোগ দিতে চায় না, সেখানে খোলা জায়গায় তাদের মনোযোগ ধরে রাখাটা কঠিন। তবু বিদ্যালয়ে উপস্থিতি খুব ভালো। এমন সমস্যা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসছে, এটাই আশার কথা।

শিক্ষার্থী জয়িতা ত্রিপুরা, তরুণ বিকাশ ত্রিপুরা ও বিশ্বজিৎ ত্রিপুরা বিদ্যালয়ে আসে আট কিলোমিটার হেঁটে। তাদের মতো এমন ২০ থেকে ৩০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে, যারা বিদ্যালয়ে দূর থেকে আসে। গরমে ঘেমে বিদ্যালয়ে এসে আবার রোদ মাথায় নিয়ে ক্লাস করতে হয় তাদের। গাছের ছায়া দিনের সব সময় এক দিকে পড়ে না। তাই অসুবিধা হচ্ছে ক্লাস করতে।

বিদ্যালয়ের পরিত্যক্ত ভবনটিতে গিয়ে দেখা যায়, চার কক্ষবিশিষ্ট ভবনের কক্ষ ও বারান্দার পিলার থেকে পলেস্তারা খসে পড়েছে, দেখা দিয়েছে ফাটল। একটি কক্ষে গিয়ে দেখা গেছে ইট ও সুরকির সঙ্গে বের হয়ে আছে দুই ফুট লম্বা একটি কাঠ।

বিদ্যালয়ের সভাপতি সুপ্রিয়া ত্রিপুরা বলেন, ‘এলাকার আশপাশে কোনো বিদ্যালয় নেই। ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার দূর থেকে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আসে এই বিদ্যালয়ে। কিছুদিন পর বর্ষা শুরু হবে। তখন কীভাবে বিদ্যালয় চলবে এ নিয়ে চিন্তায় আছি।’

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফাতেমা মেহের ইয়াসমিন বলেন, ‘অস্থায়ী ভবন নির্মাণের জন্য তিন লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই অস্থায়ী ভবন নির্মাণ করা হবে। স্থায়ী ভবন নির্মাণের জন্য মন্ত্রণালয়ে কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে।’