পুকুর ও জলাশয় ভরাটের আইন লঙ্ঘন করে মাদারীপুরের শিবচরে সরকারি একটি পুকুর ভরাট করা হয়েছে। কেটে ফেলা হয়েছে চারটি বড় গাছ। আর এসব করা হয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একটি ভবন নির্মাণের জন্য।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ১২ বিঘা জমির ওপর। আর পুকুরটি ছিল দুই বিঘার ওপর। পুকুরটিতে মাছ ছিল। কিছু মাছ ধরা হয়েছে, আর কিছু বালুচাপা পড়েছে। পরিবেশসচেতন স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আরও খালি জায়গা ছিল। পুকুর ভরাট না করেও ভবনটি অন্যত্র করা যেত।

প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ অনুযায়ী, কোনো পুকুর, জলাশয়, নদী, খাল ইত্যাদি ভরাট করা বেআইনি। আইনের ৫ ধারা অনুযায়ী, প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন বা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার, ভাড়া, ইজারা বা হস্তান্তর বেআইনি। কোনো ব্যক্তি এ বিধান লঙ্ঘন করলে আইনের ৮ ও ১২ ধারা অনুযায়ী পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই সঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (২০১০ সালে সংশোধিত) অনুযায়ী, যেকোনো ধরনের জলাশয় ভরাট করা নিষিদ্ধ।

উপজেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, পুকুরটিতে প্রতিবছর মাছের পোনা অবমুক্ত করা হতো। সম্প্রতি ৩১ শয্যার হাসপাতালটি ১০০ শয্যায় সম্প্রসারণ করতে কাজ শুরু করে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। এর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ২৩ কোটি ১৬ লাখ টাকা। হাসপাতালটি সম্প্রসারণ ও আধুনিক করতে পুরোনো দুটি ভবন ভেঙে ফেলার কাজ চলছে। ভবন সম্প্রসারণের নামে হাসপাতালের ভেতরে থাকা একটি পুকুর ভরাট করে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। অথচ পুকুর ভরাটে তারা জেলা প্রশাসন বা পৌরসভার কোনো অনুমতি নেয়নি।

শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার অফিস থেকে কয়েক শ গজ দূরে পুকুরটি হলেও আমি জানতামই না যে পুকুরটি ভরাট করে ফেলা হয়েছে। আমি গত বছরও হাসপাতালের এ বড় পুকুরে সরকারিভাবে মাছ অবমুক্ত করেছিলাম।’

১৭ আগস্ট শিবচর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, পুকুরটি বালু দিয়ে ভরাটের কাজ শেষ করেছেন শ্রমিকেরা। ভরাট শেষে ড্রেজারের পাইপগুলো অন্যত্র সরিয়ে রেখেছেন তাঁরা। পুকুরে পানি নেই, কয়েকটি হাঁস পানির অভাবে বালুর মধ্যেই পানি খুঁজে বেড়াচ্ছে।

* প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ অনুযায়ী, কোনো পুকুর, জলাশয়, নদী, খাল ইত্যাদি ভরাট করা বেআইনি। * সম্প্রতি ৩১ শয্যার হাসপাতালটি ১০০ শয্যায় সম্প্রসারণ করতে কাজ শুরু করে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর।

পুকুরের খননকাজে নিয়োজিত শ্রমিক সোহেল মিয়া বলেন, চারটি ড্রেজারের পাইপ বসানো হয়েছে পুকুর ভরাটের জন্য। এখানে তিন লাখ ফুট বালু পড়েছে। বালু আনা হয়েছে আড়িয়াল খাঁ নদ থেকে। বেশি ড্রেজার পাইপ বসানোর কারণে মাত্র চার দিনেই পুকুরটি ভরাট করা গেছে। পুকুর ভরাটের আগে জায়গাটা কেমন ছিল জানতে চাইলে এই শ্রমিক বলেন, পুকুরে মাছ ছিল। পানি ছিল। ভরাট হওয়ার কারণে কিছু মাছ এলাকার লোকজন ধরতে পারলেও অনেক মাছ বালুর নিচে চাপা পড়েছে।

এদিকে গত শনিবার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স চত্বরে গিয়ে কয়েকজন শ্রমিককে গাছ কাটতে দেখা গেল। কথা বলে জানা গেল, তাঁরা দুটি মেহগনি ও দুটি কড়ইগাছ কেটেছেন।

জানতে চাইলে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শশাঙ্ক চন্দ্র ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে ঠিকাদার আছে আর স্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ আছে। গাছ কাটার বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।’ গাছগুলো তো উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের। দরপত্র ছাড়া কাটার বিধান আছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হাসপাতালের নতুন ভবন হচ্ছে। সেখানে কী করা লাগবে না লাগবে, সেটা স্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ দেখে। পুকুর ভরাটের ব্যাপারে শশাঙ্ক চন্দ্র ঘোষের ভাষ্য, ভবন করতে পুকুর ভরাট করা লাগছে কি না, সেটিও স্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ বলতে পারবে।

মাদারীপুর স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নাজমুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘নতুন ভবনের কিছু অংশ পুকুরের ভেতরে গিয়ে পড়বে বলে শুনেছি। তাই পুকুর ভরাট করা হয়েছে। তবে পুকুরটি পুরোপুরি ভরাটের বিষয়ে আমি সেভাবে জানিও না।’ জলাশয় ভরাট আইনত নিষিদ্ধ। এরপরও কেন পুকুরটি ভরাট করা হলো এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি এখানে নতুন। সবকিছু সেভাবে জানি না। বিষয়টি দেখে বিস্তারিত পরে জানাব।’

মাদারীপুর উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি মাসুদ পারভেজ প্রথম আলোকে বলেন, মুক্ত জলাশয় উদ্ধার করা না গেলে পরিবেশের চরম বিপর্যয় ঘটবে। শিবচরে পুকুর ভরাটের পেছনে যাঁরা জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান তিনি। কর্তৃপক্ষ চাইলে ভবনটি অন্যত্র নির্মাণ করতে পারত বলে মনে করেন তিনি।